ঋণ পুনরুদ্ধার ও অন্যান্য অপরিশোধিত পাওনা আদায়ে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংকের মামলা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে গ্রাহকদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়ে পুরো আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক তথ্যমতে, সারাদেশের অর্থঋণ আদালতগুলোয় গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংকের বিচারাধীন মামলা ছিল ৬,৮৭৬টি। এসব মামলার সাথে জড়িত প্রায় ১৬,০০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে শুধু ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতে ব্যাংকের কাছে ব্যাংকের পাওনা/ঋণ আদায়ের মোট ৩,৬৩৪টি মামলা চলমান। এসব মামলায় জড়িত প্রায় ৭,৫০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, বিচারিক আদালতের ডিক্রি বা রায়ের বিরুদ্ধে প্রায় ৯৮০টি আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আর আপিল বিভাগে রয়েছে প্রায় ১১৬টি আপিল।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়- গত কয়েক বছর ধরেই ব্যাংক বনাম ব্যাংকের মামলা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে – ২০২২ সালে মামলা হয়েছে ১,২২৩টি, ২০২১ সালে ১,০৮১টি এবং ২০২০ সালে ৮৩ টি। ঢাকার অর্থঋণ আদালত-৩ এ বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ১১ হাজার মামলা। এই মামলাগুলোর মধ্যে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যাংকের মামলা রয়েছে প্রায় ৮৯৬টি। আদালত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ব্যাংক বনাম ব্যাংক মামলার মধ্যে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য এলসির গ্যারান্টর বা একসেপ্টেন্স সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে মামলা প্রায় ৭০ শতাংশ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ এবং গবেষণা সংস্থা- পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সতর্ক করে বলেছেন, ব্যাংকের সাথে ব্যাংকের বিরোধ এই শিল্পের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। তিনি বলেন, বিরোধ এরকম বাড়তে থাকলে তা গ্রাহকদের আস্থা কমাবে। দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আস্থার ঘাটতি মারাত্মক রূপ নেওয়ার আগেই এই সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান মনসুর।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে দুটি বড় ব্যাংকের একটি মামলার উদাহরণ দেওয়া যাক। ভেলভেট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড নামের একটি টেক্সটাইল কোম্পানি ২০০১ সালের এপ্রিলে সিটি ব্যাংকের মতিঝিলস্থ প্রিন্সিপাল অফিসের মাধ্যমে ৪০,০০০ ডলার মূল্যের একটি এলসি জারি করে। স্কয়ার ইয়ার্ন নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তুলা কিনতে ঋণপত্রটি জারি করা হয়।
এই লেনদেনে, স্কয়ার ইয়ার্নের পক্ষে এলসি আলোচক ব্যাংক হিসেবে ছিল মতিঝিলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রধান শাখা। কালকে এসেস্কয়ার ইয়ার্ন গ্রাহকের কাছে তুলার চালান পাঠানোর পর মার্কেন্টাইল ব্যাংকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকল নথি সিটি ব্যাংকের কাছে প্রেরণ করে। এলসি ইস্যুকারী ব্যাংক হিসেবে, সিটি ব্যাংক নথিগুলো গ্রহণ করে।
এরপর সিটি ব্যাংক মাকের্ন্টাইল ব্যাংককে জানায় যে, বিলটি উপযুক্ত হলে ১২০ দিনের মধ্যে মার্কেন্টাইল ব্যাংককে অর্থপ্রদান করা হবে। সেই হিসেবে মার্কেন্টাইল ব্যাংক বিক্রেতার ৪০ হাজার ডলার পরিশোধ করে। কিন্তু তিনবছর পরও যখন সিটি ব্যাংক পেমেন্ট করলো না – তখন ২০০৪ সালে টাকা আদায়ে সিটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঢাকার অর্থঋণ আদালত-১ এ মামলা করে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। এ মামলায় ২০০৬ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অনূকুলে রায় দেন আদালত। আদালত সুদ বাবদ অতিরিক্ত ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধের ডিক্রি জারি করেন। পরবর্তীতে সিটি ব্যাংক সেই টাকা পরিশোধ করে।
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রধান শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক এমএ শাহজাহান বলেন, ২০০৩ সালে অর্থঋণ আদালত আইন প্রনয়নের পর কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে অন্য ব্যাংকের পাওনা আদায়ে এটিই প্রথম মামলা। তখন স্থানীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ডলারের মাধ্যমে এলসি করা হতো। গত ছয়মাস আগে স্থানীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার মাধ্যমে লেনদেন বাধ্যতামূলক করেছে।
সিটি ব্যংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, রপ্তানির বিপরীতে ওই গ্রাহকের প্রায় ৫০ হাজার ডলার সিটি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখায় জমা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, তিনি তা সিটি ব্যাংকে জমা হয়নি। পরে ওই গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করে সিটি ব্যাংক। তবে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলার সর্বশেষ অবস্থা জানাতে পারেননি সিটি ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা।
কেন মামলা হচ্ছে?
ব্যাংক কোম্পানি আইনের একজন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইমরান আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, অর্থঋণ আদালতে শুধু খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা দায়ের করা যাবে এমন সীমাবদ্ধতা নেই। তার মতে, এই আইনে যেকোনো ধরনের ঋণ আদায়ে মামলা দায়েরের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রায়ই এলসির মাধ্যমে লেনদেন হয়। এই এলসি খুলতে গেলে- একটি ব্যাংকের অন্য ব্যাংকের কাছে গ্যারান্টর হিসেবে থাকতে হয়। সেটি স্থানীয় ব্যাংকের সাথে স্থানীয় ব্যাংকের মধ্যে হতে পারে। আবার স্থানীয় ব্যাংকের কাছে বিদেশি কোনো ব্যাংকও হতে পারে। গ্যারান্টর হিসেবে নিয়োগের পর যদি এলসি আলোচক ব্যাংকের কাছে পেমেন্ট না করে, তাহলে পাওনা টাকা আদায়ে ব্যাংকটি মামলা করতে পারবে।
এছাড়াও ‘ইনডেমনিটি’র বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন ইমরান। এইক্ষেত্রে কোনো গ্রাহককে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বা এলসির বিল যেন দিয়ে দেওয়া হয় – সেজন্য একটি ব্যাংক অপর ব্যাংককে লিখিত নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু, গ্রাহক যদি টাকা নেওয়ার পর সেই টাকা সময়মতো পরিশোধ না করে, তখন ওই টাকা আদায়ে ইনডেমনিটি প্রদানকারী ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে টাকা প্রদানকারী ব্যাংক। এই ব্যাংক কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, এছাড়াও অনেকসময় পে-অর্ডার সংক্রান্ত জটিলতার কারণেও কোনো ব্যাংক অপর ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করে।
ব্যাংকাররা যা বলছেন
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ যে প্রতিনিয়ত বাড়ছে- সে বিষয়টি উল্লেখ করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদানি-রপ্তানির জন্য এলসি বাধ্যতামূলক; একারণে ব্যাংকের সাথে ব্যাংকের বিরোধও বাড়ছে। তবে এই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ. (রুমি) আলী বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলার পাশাপাশি ব্যাংকের সাথে ব্যাংকের লেনদেন সংক্রান্ত আইনি-বিরোধের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা রয়েছে। তবে যে পরিমাণ মামলা, সে তুলনায় পর্যাপ্ত আদালত ও বিচারক নেই।
তিনি বলেন, আন্তঃব্যাংক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিতে পারে। বিভিন্ন দেশে এসব বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সালিশি ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এছাড়াও উন্নত দেশের আদালতে এমন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ‘অলটারনেটিভ ডিসপিউট রেজুলেশন’ (এডিআর) অনুসরণ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশও সেটি অনুসরণ করতে পারে। এছাড়াও কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে, সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকা দরকার বলেও মনে করেন অভিজ্ঞ এই ব্যাংকার।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ