বিজ্ঞানীরা প্রাচীনতম মানুষের পায়ের ছাপ আবিষ্কার করেছেন, যেগুলি ৩ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানব জাতির বলে অনুমান।
‘হাইডেলবার্গ পিপল’, যা বহুকাল ধরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মানুষের একটি প্রজাতি, তাদের সংরক্ষিত প্রিন্ট জার্মানিতে আবিষ্কার হয়েছিল। প্রাচীন মানুষের এই উপ-প্রজাতি, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘হোমো হাইডেলবার্গেনসিস’ নামে পরিচিত, তারাই প্রথম বাসা তৈরি করে এবং বড় প্রাণী শিকার করেছিল।
কিন্তু প্রায় ২৮,০০০ বছর আগে তারা পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তারা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনির শোনিনজেনের প্যালিওলিথিক সাইট কমপ্লেক্সে প্রাচীন মানুষের পাশাপাশি হাতির পদচিহ্নও মিলেছে। ইউনিভার্সিটি অফ টুবিনজেন (SHEP) এর বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারটি করেছিলেন, যারা সাইটে পাওয়া প্রাচীন নমুনাগুলিকে একত্রিত করেছিলেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘সেই সময়ে ঘাসে ভরা খোলা বনাঞ্চল এবং পাইন বনে, কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ এবং কয়েকশ মিটার চওড়া একটি হ্রদ ছিলো। হাতি, গন্ডার এবং মানুষের পায়ের ছাপ প্রমাণ করে তারা কর্দমাক্ত নদীর তীরে পানি খেতে এবং স্নান করতে আসতো।”
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, শোনিনজেনের তিনটি মানব চিহ্নের মধ্যে দুটি অল্পবয়সী ব্যক্তিদের। গবেষণার প্রথম লেখক ডাঃ ফ্লাভিও আলতামুরা বলেছেন: ‘ঋতুর উপর নির্ভর করে, হ্রদের চারপাশে গাছপালা, ফল, পাতা, অঙ্কুর এবং মাশরুম পাওয়া যেত। আমাদের অনুসন্ধানগুলি নিশ্চিত করে যে বিলুপ্ত মানব প্রজাতিগুলি অগভীর হ্রদ বা নদীর তীরে বাস করত।
শিশু এবং যুবকদের পায়ের ছাপ প্রমাণ করে এটি প্রাপ্তবয়স্ক শিকারীদের নয়, বরং তারা নদীর তীরে ভ্রমণ করতে আসতো।’ মানুষের পায়ের ছাপগুলি ছাড়াও, গবেষক দলটি বিলুপ্তপ্রায় হাতির প্রজাতি প্যালেওলোক্সোডন অ্যান্টিকাসের ট্র্যাকের একটি সিরিজ বিশ্লেষণ করেছে।
প্যালেওলোক্সোডন অ্যান্টিকাস সেই সময়ে বৃহত্তম স্থলজ প্রাণী ছিল, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ওজন হতো ১৩টন পর্যন্ত। শোনিনজেনে খননকার্যের প্রধান ডি জর্ডি সেরেঞ্জেলি বলেছেন: ‘এখানে আমরা যে হাতির ট্র্যাক আবিষ্কার করেছি তা ৫৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট। কিছু ক্ষেত্রে, আমরা কাঠের টুকরোও পেয়েছি যা প্রাণীরা মাটিতে চাপা দিয়েছিল, সেই সময়ে এগুলি বেশ নরম ছিল। গন্ডারের নমুনাও মিলেছে।
স্টেফানোরিনাস কির্চবার্গেনসিস বা স্টেফানোরিনাস হেমিটোয়েকাস প্রজাতির প্রথম পায়ের ছাপ যা ইউরোপে পাওয়া গিয়েছিল। ২০২১ সালে, বিজ্ঞানীরা নিউ মেক্সিকোতে আবিষ্কৃত ২৩,০০০ বছরের পুরানো মানুষের পায়ের ছাপের একটি সেট উন্মোচন করেছিলেন যা আমেরিকাতে মানুষের উপস্থিতির প্রথম প্রমাণ হিসাবে বিশ্বাস করা হয়েছিল। বৃটিশ এবং আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিকরা দক্ষিণ নিউ মেক্সিকোতে হোয়াইট স্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কের শুষ্ক লেকবেডে নরম কাদার প্রিন্টগুলি উন্মোচন করেছেন।
ট্র্যাকের উপরে এবং নীচে রেডিওকার্বন ডেটিং ব্যবহার করে, মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপের বিশেষজ্ঞরা অন্তত ২,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হওয়া পদচিহ্নগুলিকে পরখ করেছেন।
প্রাচীনতম ট্র্যাকগুলি প্রায় ২৩,০০০ বছর আগের, যখন বরফের চাদর উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং সমুদ্রের স্তর আজকের তুলনায় প্রায় ৪০০ ফুট নিচে ছিল। মনে করা হয় ১৩ হাজার থেকে ১৬ বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সরা প্রথম উত্তর আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল। আমেরিকার বরফের শীট গলে যাওয়ার পরে তারা সেখান থেকে সরে যায়।
কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রায় ১৬,০০০ বছরেরও বেশি পুরানো মানুষের বাসস্থানের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ দাবি করেছেন। পলি, প্রাণীর হাড় এবং কাঠকয়লার নমুনা থেকে রেডিওকার্বন মারফত তারিখগুলি বিশ্লেষণ করে কিছু বিজ্ঞানী দাবি করছেন প্রায় ৩৩,০০০ বছর আগে মানুষ আসলে পাথরের নমুনা তৈরি করেছিল কিনা।
এদিকে, এত বছর ধরে গবেষকদের ধারণা ছিল, ইথিওপিয়াতে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন বছর আগে মানব পূর্বপুরুষরা পাথরের সরঞ্জাম ব্যবহার করতেন। কিন্তু সম্প্রতি-প্রকাশিত এক নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের সরঞ্জাম তৈরি শুরু হয় প্রায় ৩ লক্ষ বছর আগে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জায়গায়।
ভাইস ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এসব সরঞ্জাম ব্যবহারকারীরা আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষও ছিল না।
এ ধরনের ‘ওল্ডোওয়ান’ টুল তৈরিকে আদতে বিবর্তনের ইতিহাসে একটি ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ধরা হয়। তখনকার সময়ের তুলনায় এসব উন্নত সরঞ্জামের আবির্ভাবকে সংস্কৃতির বিকাশের একটি মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়। তাছাড়া, মানব বুদ্ধিমত্তার উত্থান নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার একটা বড় ক্ষেত্রও এগুলো।
নতুন প্রকাশিত এ গবেষণাপত্রমতে, কেনিয়ার নায়াঙ্গায় অবস্থিত একটি সাইটে ৩.০৩২ থেকে ২.৫৮১ মিলিয়ন বছর পুরনো সরঞ্জামাদির সন্ধান পাওয়া গেছে।
২০১৫ সাল থেকে সাইটটি খনন করে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ৩৩০টি নিদর্শন (সরঞ্জাম সহ), ১৭৭৬টি হাড় এবং দুটি হোমিনিনের চোয়াল আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু সরাসরি কোনো মানব পূর্বপুরুষের অন্তর্ভুক্ত ছিল না তারা।
গবেষণার সিনিয়র লেখক রিক পটস এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, “যে সরঞ্জামগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোর সাহায্যে একটি হাতির চোয়াল কিংবা সিংহের ধারালো দাঁতের চেয়েও ভালোভালোভাবে কোনোকিছু কাটা সম্ভব।”
তিনি বলেন, ওল্ডোওয়ান টুল আসলে দেহের বাইরে একেবারে নতুন একসেট দাঁত তৈরি করার মতো বিষয় ছিল। এর মাধ্যমে আফ্রিকাতে নতুন ধরনের খাদ্য আহরণের সুযোগ পায় আমাদের পূর্বপুরুষরা।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এ পাথুরে সরঞ্জামগুলোর ব্যবহার শুরু হয় ২.৯ মিলিয়ন বছর আগে।
কুইন্স কলেজের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং গবেষণার প্রধান লেখক থমাস প্লামার একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে লিখেছেন, “এটি ওল্ডোয়ান হাতিয়ারের একটি অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন। আমরা এতদিন যা ভাবতাম, তার আরও বহু বছর আগে থেকেই এ হাতিয়ারের ব্যবহার হয়ে আসছে।”
আরেকটি দুর্দান্ত বিষয় হলো, এত আগে তৈরি এ সরঞ্জামগুলো আবিষ্কারের পরও কার্যকর ছিল। এই সরঞ্জামগুলো ছাড়াও গবেষকরা দুটি হিপ্পোর হাড় আবিষ্কার করেছেন, যাতে বোঝা যায়, হোমিনিনরা এসব যন্ত্র ব্যবহার করে বড় আকারের প্রাণীও শিকার করতে পারতো।
এমনকি গবেষকরা এ সাইট থেকে ‘প্যারানথ্রপাস’ এরও চোয়াল আবিষ্কার করেছেন। প্যারানথ্রপাস গণের প্রাণীরা আধুনিক হোমো স্যাপিয়েন্সের পূর্বপুরুষ না, বরং তাদেরকে আমাদের বিবর্তনীয় আত্মীয় বলা যেতে পারে। তাছাড়া, এগুলোকে এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম প্যারানথ্রপাস জীবাশ্ম হিসেবেও উল্লেখ করেছেন তারা।
এতদিন ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হতো যে, ওল্ডোওয়ান সরঞ্জামগুলো হোমো গণের প্রাণীরাই ব্যবহার করতো। কিন্তু নতুন এ আবিষ্কার থেকে স্পষ্ট যে এধরনের আধুনিক (তখনকার সময়ের হিসাবে) সরঞ্জামের প্রচলন হোমিনিনদের মধ্যেও ছিল। এই গণের প্রাণীদের বুদ্ধিদীপ্ত আচরণেরও প্রকাশক এসব সরঞ্জাম।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯১৫
আপনার মতামত জানানঃ