হিমালয়ের কাছে এক প্রত্নতাত্বিক খননকাজের সময় প্রায় ৬০ লক্ষ বছরের পুরোনো এক বিড়ালের মাথার খুলি খুঁজে পান মার্কিন ও চীনা জীবাশ্মবিদরা। তুষারাঞ্চলের চিতাবাঘের মতো দেখতে এই বড় বিড়ালটির নাম দেয়া হয়েছে ‘প্যান্থেরা ব্লিথিয়ে’। খুলিটির বয়স নির্ণয় করে জানা গেছে, এটি প্রায় ৪১ লক্ষ থেকে ৬০ লক্ষ বছরের পুরোনো। তাছাড়া, জীবাশ্ম এবং এর ডিএনএ পরীক্ষা করে খুলিটি যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বড় বিড়ালের তাও নিশ্চিত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মধ্য এশিয়াতে বিশাল আকৃতির এ বিড়ালের ফসিল পাওয়া যাওয়ায় বোঝা গেল, আফ্রিকা নয় বরং এ অঞ্চলই প্রাচীন সেই বড় বিড়ালের আবাসস্থল এবং এখান থেকেই তারা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে ১৯৭০ এর দশকে তানজানিয়াতে প্রাচীন বিড়ালের দাঁতের জীবাশ্ম পাওয়া যায়।সেটির বয়স ছিল প্রায় ৩৬ লক্ষ বছর।
আর নতুন ফসিলটি ২০১০ সালে দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলীয় তিব্বতের প্রত্যন্ত জান্দা বাসিনে খননকাজ চালানোর সময় খুঁজে পায় সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর সেং ও তাঁর স্ত্রী জুয়ান লিউকে নিয়ে গঠিত জীবাশ্মবিদদের একটি দল।
গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে বিড়ালের প্রথম দেখা মেলে মধ্যপ্রাচ্যে আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে, নিওলিথিক যুগে। ইঁদুর থেকে ফসল রক্ষার জন্যই মূলত তাদেরকে পালা শুরু করে মানুষ। কিন্তু তখন বিড়ালকে খাবার দেওয়ার প্রবণতা মানুষের মধ্যে তেমন একটা। খাবারের জন্য এরা মানুষের ওপর নির্ভর ছিল না, নিজেদের খাবার নিজেরাই জুটিয়ে নিত। কুকুর যেমন শিকারে সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে মানুষের পাশে ছিল এবং মানুষের ফেলে দেওয়া খাবারের উপরেই নির্ভরশীল ছিল, বিড়ালের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটি ঘটেনি। তাই মানুষের সাথে বিড়ালের সম্পর্কটি শুরু থেকেই বেশ দূরত্বপূর্ণ ছিল।
আপনার সোফা বা বিছানায় শুয়ে ঘুমানো বিড়ালটি আপনার অনেক ঘনিষ্ঠ হলেও এর পূর্বপুরুষেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল না। অনেকটা বুনো স্বভাব নিয়েই এরা মানুষের সঙ্গী হয়েছিল। তাই এত বছর পরেও বর্তমানে মানুষ বিড়ালকে আদর ও ভালবাসা দিয়ে অনেক আপন করে নিলেও বিড়াল এদের আগের স্বভাব খুব বেশি বদলাতে পারেনি।
‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাট কেয়ার’ সংগঠনের ডাক্তার ও ট্রাস্টি ক্যারেন হিয়েস্ট্যান্ড এ প্রসঙ্গে বলেন, “এটা আসলে বিড়াল প্রজাতিটির ওপর মানুষের ভুল বোঝাবুঝি। মানুষ আর কুকুর বহু বছর একসঙ্গে থেকেছে। বলা যায়, এদের বিবর্তন হয়েছে প্রায় একসাথেই। কিন্তু বিড়ালের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সে তুলনায় খুবই নতুন। বিড়ালের পূর্বপুরুষরা একাকী থাকা স্বভাবের প্রাণি ছিল, যারা খুব একটা সামাজিক নয়।”
পৃথিবীর আদিমতম প্রাণীদের মধ্যে বিড়াল অন্যতম। বিবর্তনমূলক প্রাণী গবেষকগণের গবেষণায় দেখা যায় প্রায় ১ লাখ বছর আগে থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত অংশ নিয়ে আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত বিড়ালের বিচরণ ছিল। তখন ছিল বন্যবিড়াল প্রজাতির প্রাণী। কালের বিবর্তনে জিনগত পরিবর্তনে তাদের বংশধরদের বিকশিত করে ৮ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে বন্যবিড়াল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মধ্যপ্রাচ্যের কাছাকাছি এসে নিরক্ষীয় পূর্ব বন্যবিড়াল গার্হস্থ্য বিড়াল শ্রেণিবদ্ধ হতে থাকে। সাড়ে সাত হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন মিশরে বিড়াল পূজার নিদর্শন পাওয়া যায়।
নব্যপ্রস্তরযুগে বিড়াল গৃহপালিত প্রাণী হিসাবে পরিচিতি শুরু করে। সাড়ে পাঁচ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনে বিভিন্ন প্রজাতির বিবর্তন হয়ে পুরোপুরি স্বাধীন গৃহপালিত বিড়ালে পরিণত হওয়ার হদিস পাওয়া গেছে। প্রজাতি ভেদাভেদ করলে দেখা যায় ইন্টারন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ ক্যাট ব্রিডার্স এ্যালায়েন্স বলছে গৃহপালিত ও বন্যবিড়াল মিলে ৭৩ জাতের বিড়ালের খুঁজ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ক্যাট অ্যাসোসিয়েশন তাঁদের হিসাব অনুযায়ী বিড়ালের প্রজাতি ৫৮ টি, এই হিসাবের প্রজাতি ভাগাভাগিতে লোমের বিষয়টি গণ্য করা হয়নি। ছোট-বড় লোমস বিড়ালের আলাদা জাত নেই। বিড়ালের প্রায় সর্বাধিক প্রজাতি গৃহপালিত হলেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে পার্সিয়ান প্রজাতির বিড়াল।
বাংলাদেশের বেলায়ও বিচিত্র রংয়ের ধরনের নকশাধার অত্যাধিক লোমবিশিষ্ট এই পার্সিয়ান বিড়ালের জনপ্রিয়তা বেশ সুপ্রাচীন। সারা দেশেই এর অবাধ বিচরণ। যদিও এর আদি উৎস পারস্য এলাকায়। এখানকার ইরান-তুরস্ক ও তৎসংলগ্ন এলাকায় জানা যায় ১৬০০ শতকের দিকে ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য জনপ্রিয় এই বিড়ালপ্রজাতি ইউরোপ, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ঘুরে বাংলাদেশে এসে থিতু হয়। সমতল মুখায়বের গোলাকার মুখমণ্ডলে হৃষ্টপুষ্ট খাট, শান্ত স্বভাবের এই প্রজাতি সৌখিন বিড়ালপ্রেমীদের বেশ আকৃষ্ট করে। হালকা ছাই, ধূসর, সোনালী, রূপালী, বাদামী, সাদা-কালো, কমলা রংঙের ডোরাকাটা নকশার বিচিত্র- বৈচিত্র্যের কারণে খুব সহজেই আকর্ষণ জাগে। পোষার প্রতি আগ্রহী হয়। আদরণীয় গঠনশৈলীর ছোটখাট আকারের জন্য এর যত্ম-আত্তিতেও তেমন সমস্যা হয় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বজুড়ে বিড়ালপ্রেমীদের হৃদয়কোঠরে মিষ্টি স্বভাবের এই বিড়াল গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে।
ক্যাট ফ্যান্সিস অ্যাসোসিয়েশনের জড়িপে সারা পৃথিবীতে গৃহপালিত বিড়ালের সংখ্যা ৫০০ মিলিয়ন। দুঃখজনক হতাশার হিসাবও তাঁরা সংরক্ষণ করে যে, প্রতিবছর কেবল এশিয়াতেই ৪ মিলিয়ন বিড়াল মানুষ কর্তৃক হত্যা করা হয়, খেয়ে ফেলা হয়। বিড়ালপ্রেমী ও গবেষকগণ বিড়ালের প্রতি মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভবের নানা সুখকর কারণ উদ্ভাবন করেছে। প্রাণী পোষা অনেকেরই প্রিয় সখ। কবুতর, টিয়া, ময়না, কুকুর, খরগোশসহ চতুষ্পদী প্রাণী লালন পালন করে থাকে। তবে বিড়াল পালার আনন্দ উপকারিতা ভিন্ন। ঘরের নিরাপত্তা, সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও নাকি বিড়াল প্রভূত নিরাপদ উপকারি ভূমিকা পালন করে।
জীবনের দুই তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়ে পার করা এই প্রাণীর মিউমিউ ধ্বনি, বিশ্বের সবচেয়ে আনন্দধ্বনিগুলির মধ্যে একটি। এই ধ্বনি মানুষের অস্থিসন্ধি ও মাংশপেশীর চিকিৎসায় থেরাপি হিসাবে কাজ করে। বিড়াল অন্ধকারে পরিষ্কার দেখতে পায়। তা ঘুটঘুটে অন্ধকার হোক না কেন; সাধারণ মানুষের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি। শব্দহীন হাঁটাচলা করতে পারে। যাঁরা বিড়াল পুষেন তাঁদের ঘুম ভাল হয়। বিড়ালের সাথে সময় কাটালে মানুষের শরীরের আরামদায়ক রাসায়ানিক পদার্থ নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়; ফল মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, দুশ্চিন্তামুক্ত রাগ-উদ্বেগহীন প্রশান্তীর জীবন। ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট ও গবেষণায় জানিয়েছে যেসব শিশু বিড়ালপ্রেমে মগ্ন থাকে তাঁদের ক্ষতিকর বাড়তি অ্যালার্জি হয় না। গৃহপালিত অন্যসব প্রাণীর চেয়ে বিড়াল অনেক বেশী পরিবেশ উপকারী। যন্ত্রণা উপশমদায়ক। বিশেষ করে ইঁদুর অতিষ্ঠতার ক্ষেত্রে। ইঁদুরের যমদূত বিড়াল।
যাদের জিন, ভূত, প্রেত সংক্রান্ত অতিপ্রাকৃতিক অপশক্তিতে বিশ্বাস, বিড়াল তাঁদের উদ্ধারকর্তা। প্রকৃত বন্ধু। অশুভ পরমমুক্তি। যাঁদের অখণ্ড অবসর, বিড়াল হতে পারে সেই সব ব্যক্তির নিরাপদ সঙ্গী, আনন্দ প্রশান্তির অপার অনুষঙ্গ। বিড়াল সেবাযত্ম ব্যবস্থার ফাঁকে নিজের প্রতিও যত্মশীল হয়ে ওঠে। শরীর স্বাস্থ্য স্মার্ট বানায় বিড়াল। হৃদরোগের ঝুঁকিও নাকি কমে, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনার ফলে শতাংশের হিসাবে তা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
অতি প্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী কালোবিড়াল বহুকাল থেকে মানুষের কল্পনার বিষয়বস্তু হিসাবে গণ্য হয়ে আসছে। বিড়াল নিয়ে গল্প উপন্যাস বিশেষ করে শিশু সাহিত্য ও ছড়ায় বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। প্রকৃতিবাদী হিন্দুধর্মসহ পৃথিবীর অনেক ধর্ম বিশ্বাসে বিড়ালকে পবিত্র প্রাণী হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়। নিঃসঙ্গচারী, পরোপকারী, ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন নিঃশব্দের এই শিকারী বিড়াল জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অত্যাবশকীয় প্রাণী।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে স্তন্যপায়ী চতুষ্পদি এই বিড়াল প্রজাতি ভয়ঙ্কর দুর্দিনেও বিশ্ব প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বড় ভূমিকা পালন করে চলছে। লক্ষ-কোটি বছর আগের জীবাশ্মে বিড়াল গোত্রভুক্ত প্রাণীর নজির খুঁেজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আবির্ভাব-বিলুপ্তি, বিবর্তনক্রিয়ার যাঁতাকলে এই বিড়াল প্রজাতি চুপিসারে সগর্জনে মানুষের কাছাকাছি বসবাস শুরু করেছে। মানুষের সরাসরি উপকারে আসছে।
যে প্রজাতির বিড়াল মানুষ প্রথম বাসাবাড়িতে পালা শুরু করে তা হলো আফ্রিকান বুনো বিড়াল। এরা নিজেদের বিড়াল সমাজেই একাকী ও নির্জনে বসবাস করে। শুধুমাত্র প্রজননের সময় ছাড়া একে অন্যের সঙ্গে মেশেও খুব কম। বিড়ালই হলো একমাত্র অসামাজিক পশু যাকে মানুষ গৃহপালিত বানিয়েছে। বিড়াল ছাড়া অন্য যেসব প্রাণীকে মানুষ গৃহপালিত করেছে এদের সবগুলোরই নিজেদের প্রজাতির অন্য সদস্যদের সঙ্গে সামাজিক বন্ধন রয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৫০
আপনার মতামত জানানঃ