ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজারে যে অস্থিরতা, বাজার সিন্ডিকেটের একটা চক্রান্ত আছে। এটা আমরা সবাই স্বীকার করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীও সিন্ডিকেটকে শক্ত হাতে দমন করার পদক্ষেপ নিচ্ছেন।’ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, ‘বাজার সিন্ডিকেট দমন করার কোনো বিকল্প নেই। আমরা চাই, মানুষ হাসি মুখে যেন ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে।’
মূলত, নিত্যপণ্যের বাজারে যেন চলছে লুটপাটের মহোৎসব। ক্রমাগত বেড়েই চলেছে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। কয়েকদিনের ব্যবধানে তেল, চিনি, আলু ও পিয়াজের দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও বেশ কিছু পণ্য। হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী বেশ কিছু সবজির দামও। বাজারে বর্তমানে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। সর্বোচ্চ উঠেছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়।
প্রতিবছর ঈদুল আজহায় মসলার দাম বাড়লেও এবার আগে থেকেই বাড়তি। কিছু পণ্যের দাম রমজান মাসের চেয়েও বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে নিত্যপণ্যের বাজারে কেন এই অস্থিরতা? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়ালেও তা মূলত সিন্ডিকেট। অতি মুনাফা লাভের জন্য পণ্যের অবৈধ মজুত ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়ান তারা।
অথচ এতদিন সরকার নির্ধারিত পরিশোধিত খোলা চিনির দাম ছিল ১০৪ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনির দাম ছিল ১০৯ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে অতিরিক্ত ২০ থেকে ৩০ টাকা পকেটে ঢুকিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এরমধ্যে বুধবার পরিশোধিত খোলা চিনির দাম প্রতি কেজি ১২০ টাকা এবং প্যাকেটজাত পরিশোধিত চিনির দাম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু দাম নির্ধারণের আগেই ২০-৩০ টাকা বেশি দামে চিনি বিক্রি করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। এখন নতুন দর নির্ধারণ করে দেয়ায় বিক্রেতারা অনেকেই চিনি বিক্রি করছেন না। বাজারে হঠাৎ প্যাকেটজাত চিনি যেন উধাও। যদিও বাজারে চিনি সরবরাহে ঘাটতি নেই।
বুধবার আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে চিনির দাম কেজিতে ১৬ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। সর্বশেষ গত এপ্রিলে চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখন প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০৪ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ১০৯ টাকা করার ঘোষণা এসেছিল। শুরুতে সে অনুযায়ী বিক্রি হলেও তারপর চিনির দাম বাড়তে বাড়তে এখন ১৪০ টাকায় উঠেছে।
কয়েকদিন আগে সুগার রিফাইনার্স এসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে দাম সমন্বয় করার অনুরোধ জানালে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে মূল্য নির্ধারণে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়। যদিও এর চেয়ে বেশি বাড়ানোর দাবি ছিল ব্যবসায়ীদের। চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে গত মার্চে এক দফায় শুল্ক কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয় সরকার, যা আগামী ৩১শে মে পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। তবে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় শুল্কছাড়ের এই সুবিধা আরও কিছু সময়ের জন্য বাড়াতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশ করা হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব।
ভোজ্য তেলে তেলেসমাতি থামছেই না: বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির কথা বলে দেশে কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছিল সয়াবিন তেলের দাম। কিন্তু গত ৪ মাস ধরে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে কমানো হয়নি। বরং আরও বেড়েই চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম। প্রত্যাহারকৃত ভ্যাট চালু করায় গত বৃহস্পতিবার দেশের বাজারে সয়াবিনের দাম লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে প্রতি লিটার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৯ টাকা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গত বছর তেলের দাম সহনীয় রাখতে সরকার সয়াবিন আমদানিতে যে ১০ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করেছিল, সেটি আবার চালু করায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে আমদানিকারকদের। এখন ভ্যাটের বাড়তি টাকা ক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করতেই দাম বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে সরকারও আর ভ্যাট ছাড় দিতে রাজি নয়। ফলে বাড়তি দরের বোঝা বহন করতে হচ্ছে ভোক্তা সাধারণকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর প্রথম ৪ মাস জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৯ হাজার টন। আগের বছর একই সময়ে তা ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার টন। অর্থাৎ গত বছরের প্রথম ৪ মাসের তুলনায় এবার একই সময়ে সয়াবিন আমদানি ১৩ শতাংশ বেশি হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম ক্রমাগত কমছে।
কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এ বছরের জানুয়ারিতে আমদানি হওয়া অপরিশোধিত সয়াবিনের প্রতি টনের দাম ছিল ১ হাজার ৩৮০ ডলার। এরপর প্রতি মাসেই দাম কমেছে সয়াবিনের। ৪ মাসের ব্যবধানে সয়াবিনের টন প্রতি দাম ১১০ ডলার কমে ১ হাজার ২৬০ ডলারে নেমে এসেছে। অর্থাৎ প্রতি লিটারে ১২ টাকা কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন ধারাবাহিকভাবে সয়াবিনের দাম কমছে, তখনই দেশে লিটারে দাম বাড়ানো হয়েছে ১২ টাকা। এতে প্রতি লিটারের দাম দাঁড়িয়েছে ১৯৯ টাকা।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, ভোক্তাদের কথা চিন্তা না করেই আবারো ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রত্যাহারকৃত ভ্যাট চালু করা হয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের ওপর।
আলু-পিয়াজের সরবাহে ঘাটতি নাকি সিন্ডিকেট?
বাজারে সরবারহে ঘাটতির কারণেই আলু ও পিয়াজের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, বড় ব্যবসায়ীরা পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি করছেন। কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, আলু ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং পিয়াজ ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
ডিম ও মুরগির বাজারেও লুটপাট
রমজানের আগে থেকেই অস্থির ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজার। একদিনের ব্যবধানে আরও বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির দাম। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। আর ডিমের হালি হয়েছে ৫০ টাকা। এখানেও চলছে ইচ্ছেমতো লুটপাট। কিছুদিন আগে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশন (বিপিএ) অভিযোগ করে জানায়, মুরগির উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রান্তিক খামারিদের সরিয়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ‘মাফিয়া চক্র’। সংগঠনটির অভিযোগ, এ খাতের করপোরেট গোষ্ঠী ইচ্ছেমতো ফিড ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে দেয়, আর সেই দাম মেনে নিয়ে প্রান্তিক খামারি উৎপাদন করলে বাজারে ‘দাম কমিয়ে দিয়ে’ লোকসানে ফেলা হয়। তাতে করে প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদন থেকে ‘ছিটকে পড়ছে’। আবার খামারিরা উৎপাদনে না থাকলে ভোক্তাদের পকেট ‘ফাঁকা করে দেয়’ ওইসব বড় কোম্পানি।
সবজির বাজার আরও অস্থির
বর্তমানে বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি বিক্রি হচ্ছে না। সরজমিন কাওরান বাজারে দেখা যায়, প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০ টাকা, পটল ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৭০ টাকা, পেঁপে ৬০ টাকা, বরবটি ৭০ টাকা, গাজর প্রতি কেজি ১০০ টাকা, টমেটো ৫০ টাকা, শসা ৪০-৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ১৬০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, লাউ প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা, পিয়াজ ৬০-৭০ টাকা, রসুন ১৬০ টাকা ও আদা ২৫০-২৬০ টাকা দরে।
ঈদ না আসতেই অস্থির মসলার বাজার: কোরবানির বাকি এখনো প্রায় দুই মাস। এরমধ্যেই অস্থির হতে শুরু করেছে মসলার দাম। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব ধরনের মসলার দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। বিশ্ববাজারে বুকিং রেট বেড়ে যাওয়া, ভারত থেকে আমদানি বন্ধ রাখা এবং সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে মসলার দাম বাড়ছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। পাইকারি মসলার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি কেজি এলাচ বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৪৩০ টাকায়।
দুই সপ্তাহ আগে তা বিক্রি হয়েছে এক হাজার ৩৬০ টাকায়। তবে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে জিরার। বর্তমানে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৭৮০ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৫৮০ টাকায়। এ ছাড়া গোল মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৫২০ টাকায়। দুই সপ্তাহ আগে দারুচিনি বিক্রি হয়েছে ২৯৫ টাকায়। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৩১০ টাকায়। এ ছাড়া লবঙ্গ বিক্রি হচ্ছে কেজি ১ হাজার ৪০০ টাকায়, যা দুই সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। সপ্তাহখানেক আগেও প্রতি কেজি আদা ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বর্তমানে পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা কেজিতে। সপ্তাহের ব্যবধানে দেশি রসুনের কেজিতে বেড়েছে ৫০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১২০৫
আপনার মতামত জানানঃ