প্রতি মুহূর্তে কতশত চিন্তা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কখনও হয়তো কোনো বিরস কৌতুক কিংবা কারো সম্পর্কে কোনো অব্যক্ত নেতিবাচক ভাব, যা হয়তো আপনি কখনোই প্রকাশ করতে চান না; রাখতে চান নিজের ভেতরেই।
কিন্তু ভাবুন তো, কেউ আপনার মনের এই অব্যক্ত কথাগুলো জেনে যাচ্ছে। আপনি কী ভাবছেন, তা বলার আগেই কেউ শুনতে পাচ্ছে! দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে।
সোমবার (১ মে) অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মানুষের মনের কথা বোঝা বা ‘মাইন্ড রিড’ করার প্রযুক্তি আরও উন্নত করার ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
নেচার নিউরোসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, এফএমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্ত প্রবাহের মাত্রা বিশ্লেষণ করে মানুষের মনের একান্ত ব্যক্তিগত চিন্তাগুলোকে বলে দিতে পারে (ডিকোড) আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)।
গবেষকরা ইতোমধ্যেই এরজন্য ল্যাংগুয়েজ-ডিকোডিং মেথডস (এআইয়ের বুঝতে পারা মস্তিষ্কের অব্যক্ত ভাবনাগুলো মানুষের ভাষায় অনুবাদ করার প্রযুক্তি) তৈরি করেছেন। মূলত প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা ব্যক্তিদের জীবনকে একটু সহজ করে তুলতে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়নের পদক্ষেপ নিয়েছেন গবেষকরা। ফলাফলও এসেছে দারুণভাবে ইতিবাচক।
গবেষণায় ব্যক্তির কল্পিত বক্তব্য বা মনের ভাবকে প্রকৃত বক্তব্যে দেখাতে সক্ষম হয়েছে এআই। এমনকি যখন ওই ব্যক্তিকে একটি শব্দবিহীন চলচ্চিত্র দেখানো হয়, তখন স্ক্রিনে যা ঘটছিল তা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই ঠিকঠাক বর্ণনা করেছে এআই প্রযুক্তি।
গবেষণাটির নেতৃত্বদানকারী টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার হুথ বলেন, “এটি কেবল ভাষাই অনুবাদ করছে না, আমরা অর্থও বুঝতে পারছি, মস্তিষ্কে কী ঘটছে তার ধারণা পাচ্ছি। এটি সত্যিই খুব রোমাঞ্চকর উদ্ভাবন।”
গবেষণাটি চালানো হয় তিন ব্যক্তির ওপর। গবেষণার জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে তারা প্রতিদিন প্রায় ১৬ ঘণ্টা করে ড. হুথের ল্যাবে সময় দিয়েছেন। এ সময় ‘দ্য মথ’ সহ আরও বর্ণনামূলক বেশকিছু পডকাস্ট শোনানো হয় তাদের।
এগুলো শোনার সময় এফএমআরআই স্ক্যানারের মাধ্যমে অংশগ্রণকারীদের মস্তিষ্কের কিছু অংশে রক্তের অক্সিজেনেশনের মাত্রা রেকর্ড করা হয়। পরে এফএমআরআই স্ক্যানের সময় অংশগ্রহণকারীরা শুনছিলেন এমন শব্দ ও বাক্যাংশের সঙ্গে তাদের মস্তিষ্কের রেকর্ড করা নির্দেশনাগুলো মেলানোর জন্য একটি ল্যাংগুয়েজ মডেল ব্যবহার করেন গবেষকরা।
ড. হুথ ও তার সহকর্মীরা এই গবেষণায় আরও একটি এআই ব্যবহার করেছেন। দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের এফএমআরআই চিত্রগুলো অনেকটাই সঠিকভাবে শব্দ ও বাক্যাংশে ডিকোড করতে পেরেছে এআই। নতুন নতুন রেকর্ডিং শুনিয়েও ডিকোডারটিকে পরীক্ষা করেছেন গবেষকরা।
ফলাফলে দেখা গেছে, ডিকোড করা লিপিতে শব্দগুলো কিছুটা এলোমেলোভাবে থাকলেও, তাতে বক্তার মনের ভাব ঠিকঠাক ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। ডিকোডারটি মূলত প্যারাফ্রেজিং বা আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করছিল।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মনে মনে একটি গল্প ভাবতে বলা হয়। ওই সময় তাদের মস্তিষ্কে চালানো হয় এফএমআরআই স্ক্যান। তারা মনে মনে কী গল্প ভেবেছিলেন সেটিও পরে শুনে নেন গবেষকরা। এরপর এআইয়ের বলা গল্পের সঙ্গে তাদের চিন্তা করা গল্প মেলানো হয়।
দেখা যায়, ডিকোডিং মডেলটি তাদের চিন্তা করা গল্পের সারসংক্ষেপ ভালোভাবেই ডিকোড করতে পেরেছে।
গবেষকরা বলছেন, ফলাফলের মাধ্যমে এটিই বোঝ গেল যে, এআই শুধু ভাষাই ডিকোড করে না বরং চিন্তাভাবনার অর্থও ব্যক্ত করতে পারে।
ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির স্নায়ুবিজ্ঞানী গ্রেটা টুকুটে বলেন, “এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, আমরা কি সত্যিই মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ ধারণাগুলোকে ডিকোড করতে পারি? অব্যক্ত ভাবের অর্থ বুঝতে পারি? গবেষণার মাধ্যমে জানান গেল, হ্যাঁ, কিছুক্ষেত্রে আমরা এটি করতে সক্ষম।”
যদিও এই ল্যাংগুয়েজ-ডিকোডিং পদ্ধতির বেশকিছু সীমাবদ্ধতাও খুঁজে পেয়েছেন ড. হুথ এবং তার সহকর্মীরা। মস্তিষ্কের অব্যক্ত ধারণাগুলো জানার জন্য যে এফএমআরআই স্ক্যানারের সাহায্য নিতে হয়, তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেইসঙ্গে, মডেলগুলোকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আলাদাভাবে প্রোগ্রাম করাও একটি দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া। গবেষকরা জানিয়েছেন, কার্যকর ফল পেতে হলে ডিকোডার যন্ত্রকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আলাদাভাবে প্রোগ্রাম করতে হবে।
তারা যখন একজন ব্যক্তির জন্য প্রোগ্রাম করা ডিকোডার অন্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, তখন যন্ত্রটি মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারেনি। গবেষকরা বলছেন, এর কারণ হলো প্রতিটি মস্তিষ্ক ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে অব্যক্ত ভাবনাগুলো উপস্থাপন করে। তাই একজনের তৈরি ডিকোডার দিয়ে আরেকজনের মনের কথা বোঝা সম্ভব নয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১১০০
আপনার মতামত জানানঃ