ব্যাংককের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক কেন্দ্র সুখুমভিট রোডকে আলোকিত করা নিয়ন সাইনবোর্ডগুলোর মধ্যে এক নতুন প্রতীকের উদয় হয়েছে। পাঁচ-পাতাযুক্ত সবুজ গাঁজা পাতার এই আকস্মিক সার্বজনীনতা জোর গলায় ঘোষণা করছে, গত জুন মাসে গাঁজাকে বৈধ করার পর থেকে থাইল্যান্ডে এক বিশাল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।
ব্যাংককের বিবিসি অফিস থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে ৪০টিরও বেশি দোকান আছে, যারা গাঁজা ফুলের কুঁড়ি এবং এগুলোকে সেবন করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম বিক্রি করে। এছাড়া, ‘উইড ইন থাইল্যান্ড’ নামের ওয়েবসাইটটি ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৪ হাজার প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে, যারা দেশটিতে গাঁজা এবং এটি খাওয়ার অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করে।
থাইল্যান্ডে গত জুন মাস পর্যন্তও কেবল গাঁজা রাখার জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের শাস্তির বিধান ছিল। এছাড়াও গাঁজা উৎপাদনের জন্য ১৫ বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান ছিল, যেখানে অন্যান্য মাদক সম্পর্কিত অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। থাইল্যান্ডের মাদক সম্পর্কিত আইনের এই পরিবর্তন হয়েছে প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে।
গাঁজা শিল্প নিয়ে পরামর্শ প্রদান করা প্রতিষ্ঠান এলিভেটেড এস্টেটের প্রতিষ্ঠাতা কিটি চোপাকার মতে, “এটি অগোছালোভাবে হয়েছে, কিন্তু মূল ব্যাপার হচ্ছে এটা থাইল্যান্ড। তবে আমার মনে হয় না, গাঁজাকে হঠাৎ করে এভাবে বৈধ না করলে গাঁজা শিল্পের এই বিশাল উত্থান হতো।” এলিভেটেড এস্টেট সংসদেও এই আইন পাশ করার জন্য থাইল্যান্ডের সংসদীয় কমিটির অংশ হিসেবে কাজ করছে।
কিন্তু গাঁজাকে বৈধ করা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা চোপাকার মতো ব্যক্তিরা এই হঠাৎ বৈধকরণকে সমর্থন করেন না। তিনি জানান, “আমাদের নিয়ন্ত্রণ দরকার। আপনি কী করতে পারবেন আর কী করতে পারবেন না, তা স্পষ্ট করে বলা উচিৎ। এটি অনেক বিভ্রান্তি তৈরি করছে, অনেকেই জানেন না তারা কী করছেন, কীসের পেছনে টাকা ঢালছেন।”
আপাতদৃষ্টিতে সবার জন্য উন্মুক্ত এই গাঁজা খাওয়ার জন্যেও বেশ কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে, তবে এই নিয়মগুলো সেভাবে মেনে চলা হচ্ছে না। প্রথমত, গাঁজা বিক্রি করা প্রতিটি ডিসপেনসারির লাইসেন্স থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, দোকানগুলোতে বিক্রি করা প্রতিটি গাঁজা ফুলের উৎস এবং প্রতিটি গ্রাহকের ব্যক্তিগত বিবরণের রেকর্ড রাখতে হবে। তৃতীয়ত, গাঁজা কোনোভাবেই অনলাইনে বিক্রি করা যাবে না। চতুর্থত, অপ্রক্রিয়াজাত গাঁজা ফুল ছাড়া অন্য কোনো দ্রব্যে ০.২ শতাংশের বেশি টিএইচসি থাকা যাবে না। গাঁজায় থাকা সাইকোট্রপিক কেমিক্যালকেই টিএইচসি নামে ডাকা হয়।
কিন্তু সারা থাইল্যান্ডজুড়েই উচ্চ টিএইচসিযুক্ত গাঁজার ব্রাউনি আর গামিগুলোকে এক ঘণ্টার মধ্যেই হোম ডেলিভারি করার সুবিধা চালু করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। ২০ বছর বয়সের নিচের কোন ব্যক্তির কাছে গাঁজা বিক্রি না করার নিয়মও রয়েছে। কিন্তু গাঁজা-দ্রব্যটি যখন মোটরবাইক কুরিয়ারের মাধ্যমে হোম ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে, তখন কে জানবে গ্রাহকের বয়স কত?
থাইল্যান্ডে গাঁজা বৈধকরণের পরেই বেশকিছু রেস্তোরাঁ চালু হয়েছে, যেখানে মারিহুয়ানা টি বা মারিহুয়ানা আইসক্রিমের মতো গাঁজা দিয়ে দিয়ে তৈরি খাবার পরিবেশন করা হয়। এমনকি এ ধরনের দোকানগুলোতে গাঁজার ফ্লেভারের খাবার পানিও বিক্রি করা হচ্ছে। পুলিশরা স্বীকার করেছেন যে, তারা গাঁজার কোন জিনিসটি বৈধ আর কোন জিনিসটি অবৈধ তা সম্পর্কে নিশ্চিত নন। এ কারণে তারা মারিহুয়ানা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে খুব কম আইনি বিধি-নিষেধ প্রয়োগ করছেন।
যেভাবে উত্থান ঘটল গাঁজার
থাইল্যান্ডে গাঁজার এই উত্থান মূলত এক রাজনৈতিক দুর্ঘটনার ফসল। থাইল্যান্ডের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান আনুতিন চার্নভিরাকুল ২০১৯ সালের নির্বাচনের জন্য তার দলের ইশতেহারে গাঁজা বৈধকরণের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা তাকে ভোটে জয়লাভ করতে ভালোই সহায়তা করে, বিশেষ করে দরিদ্র কৃষকদের গাঁজা উৎপাদন করে দ্রুত টাকা আয়ের একটি সুযোগ করে দেন তিনি। নতুন সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসাবে আনুতিন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য দ্রুত গাঁজাকে নিষিদ্ধ মাদকের তালিকা থেকে সরিয়ে নেওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
কিন্তু থাইল্যান্ডের সংসদকে প্রতিযোগী দলগুলোর এক ফুটন্ত পাত্রের সাথে তুলনা করা যায়। গাঁজার এই ব্যবসা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তা ঠিক করার আগেই গাঁজাকে বৈধ করা হয়। এবং পরিকল্পিত নতুন আইনগুলো আটকা পড়ে দলগুলোর আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্বের মধ্যে। এই বছরের মে মাসে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, আর এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে গাঁজা নিয়ে আলোচনা। এবং নির্বাচনের জন্যেই এই বছর শেষের আগে নতুন গাঁজা সম্পর্কিত আইন সংসদে পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম। ইতিমধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দলগুলো অনিয়ন্ত্রিত গাঁজার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করছে, এবং জানিয়েছে তারা ক্ষমতা গ্রহণ করলে গাঁজাকে পুনরায় অবৈধ ঘোষণা করবে।
ফলে এই গাঁজা শিল্প কোনদিকে মোড় নেবে তা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে চোপাকা জানান, “গাঁজার দাম কমছে, কারণ গাঁজার যোগান অনেক। বাইরে থেকে প্রচুর পরিমাণে অবৈধ আমদানি করা হচ্ছে। আমরা বিদেশ থেকে বিভিন্ন স্ট্রেইন আনছি, যেগুলো উৎপাদনের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ এবং আলো প্রয়োজন। আমাদের উচিত এমন স্ট্রেইন তৈরি করা যা আমাদের জলবায়ুর সাথে মানানসই, যাতে খরচ কম হয়।”
“আমাদেরকে সত্যিই আমাদের পুরানো ঐতিহ্য, পুরনো সংস্কৃতিতে ফিরে যেতে হবে। কারণ গাঁজা এবং থাইল্যান্ড, একে অপরের সাথে খুব গভীরভাবে জড়িত।”
থাইল্যান্ডে গাঁজা গাঁজার ইতিহাস
অনেক থাইরা, বিশেষ করে যারা গ্রামাঞ্চলে বড় হয়েছেন, তারা গাঁজাকে বিপজ্জনক দ্রব্য হিসেবেই ধরে থাকেন। সামাজিকভাবেও গাঁজা সম্পর্কে মনোভাব নেতিবাচকই। তাই গত বছর যখন থাইল্যান্ড সরকার গাঁজাকে বৈধ ঘোষণা করে, তখন অনেকের জন্যই সেটি বিস্ময়কর ছিল। তবে বাস্তব কথা হলো গাঁজা উন্মুক্তকরণ একেবারেই সাম্প্রতিক ঘটনা।
১৯৭০-এর দশকের শেষদিক পর্যন্ত থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতিরা ব্যাপকহারে গাঁজা চাষ করতো, বিশেষ করে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত সীমান্ত এলাকা, যেটি বিশ্বের বৃহত্তম আফিমের উৎস। উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডে ভেষজ এবং রান্নার উপাদান হিসেবেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো গাঁজা।
১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যরা ‘বিশ্রাম এবং বিনোদন’-এর বিরতিতে সময় কাটানোর অংশ হিসেবে থাই স্টিক আবিষ্কার করে। মোটা সিগারের মতো দেখতে এই স্টিকগুলো তৈরি বাঁশের লাঠির চারপাশে পাতায় মোড়ানো গাঁজার ফুল থেকে। এ সময় সৈন্যরা প্রচুর পরিমাণে থাই স্টিক যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে শুরু করে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের হেরোইনের সাথে যুক্ত হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া মাদকের বিশাল একটি অংশ হয়ে ওঠে এটি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমেরিকা মাদক উৎপাদন বন্ধে থাইল্যান্ডের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালে থাইল্যান্ড একটি মাদকবিরোধী আইন পাস করে, যাতে মাদক উৎপাদন, ব্যবহার এবং বিক্রির জন্য মৃত্যুদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়।
১৯৬০-এর দশকে পশ্চিমে মাদক ও যৌনতার প্রতি আকর্ষিত এক নতুন ‘হিপ্পি’ আদর্শের জোয়ার বয়ে যায়। গাঁজা-ধূমপায়ী ব্যাকপ্যাকাররা পূর্বদিকে আসতে থাকে জীবনের অর্থ খোঁজার জন্য। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে এক ব্যাপক রক্ষণশীল মনোভাবের উত্থান হয়। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া সরকার তাদের অভিবাসন কর্মকর্তাদেরকে নির্দেশ দেয় হিপ্পিদেরকে দেখামাত্রই তাদেরকে দেশে ঢুকতে বাধা দেওয়ার জন্য। চুল লম্বা পুরুষদেরকে সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে যেকোন একটি জিনিস বাছাই করতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়: হয় নাপিতের কাছে যাও, অথবা ফিরতি প্লেন ধরো। মালয়েশিয়ায় হিপ্পিদের বৈশিষ্ট্যযুক্ত কারোর দেখা পাওয়া গেলে তাদের পাসপোর্টে ‘SHIT’ (সাসপেক্টেড হিপ্পি ইন ট্রানজিট) স্ট্যাম্প লাগিয়ে তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হতো।
এদিকে থাইল্যান্ডে বিকল্প ধারার যুব সংস্কৃতির উত্থানের জন্য চিন্তিত ছিল থাই সরকার। ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে এক বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন দমন করে থাই সরকার। এতে ব্যাংককের থাম্মাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ডজন ছাত্র মারা যায়। রক্ষণশীলরা ভয় পাচ্ছিলো তাদের প্রতিবেশী লাওস, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামের মতো তাদের দেশও কমিউনিস্ট শাসনে চলে যাবে।
ইতিমধ্যেই থাইল্যান্ডের রাজপরিবারের অর্থায়নে পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে আফিম এবং গাঁজা চাষ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরিবর্তে তাদেরকে কফি এবং ম্যাকাডামিয়া বাদাম উৎপাদনে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়।
১৯৯০-এর দশক থেকে মিয়ানমারের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকা থেকে থাইল্যান্ডে ব্যাপক পরিমাণে সস্তা মেথামফিটামিন ঢুকতে শুরু করে। মেথ আসক্তির ধ্বংসাত্মক সামাজিক প্রভাব থাই জনসাধারণকে আরও দৃঢ়ভাবে মাদকবিরোধীতে পরিণত করে। ২০০৩ সালে এক নৃশংস মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়, যাতে অন্তত ১,৪০০ জন সন্দেহভাজন ব্যবহারকারী এবং সরবরাহকারীকে গুলি করে হত্যা অথবা আহত করা হয়।
থাইল্যান্ডের কারাগার ভরে ওঠে মাদকসেবী আর ব্যবসায়ীদের ভিড়ে। কারাগারে মোট বন্দীদের তিন-চতুর্থাংশই ছিল মাদক অপরাধের সাথে জড়িত, যার অনেকগুলোই হয়তো একেবারেই ক্ষুদ্র কোনো অপরাধ। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে থাই কর্মকর্তারা তাদের কট্টরপন্থী আইনকে পুনর্বিবেচনা করা শুরু করেন, অনেকেই ভাবতে থাকেন কীভাবে গাঁজার ওষুধ এবং থেরাপিউটিক প্রয়োগের সাথে তাদের মেডিকেল পর্যটন খাতকে মেলানো যায়। ফলে এখান থেকে রিক্রিয়েশনাল গাঁজাতে পৌঁছানো অসম্ভব কিছু ছিল না।
কিছু ডাক্তার আবার গাঁজা আসক্তির বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, তবে যেসব থাই নাগরিক মেথামফিটামিন সংকটকে দেখেছেন, তাদের কাছে গাঁজার এই বিপদ তুলনামূলক বড় কিছু নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংককের ডিসপেনসারিগুলো থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, তাদের বেশিরভাগ গ্রাহক মূলত বিদেশি পর্যটক, থাই নাগরিক নয়। গাঁজা বৈধকরণের এই ঘোষণায় সবচেয়ে উৎসাহী সমর্থক হলো থাইল্যান্ডের অল্প সংখ্যক ব্যক্তি, যারা অবৈধভাবে নিয়মিত গাঁজা সেবন করতেন।
থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গাঁজাকে পুনরায় অবৈধ ঘোষণা করা কিংবা রিক্রিয়েশনাল ব্যবহারকে বাদ রেখে কেবল চিকিৎসার মধ্যে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা প্রায় অসম্ভব হবে বলে মনে করেন এর সাথে জড়িত থাকা ব্যবসায়ীরা। কারণ গত নয় মাসে পানি বহুদূর গড়িয়েছে। তবে থাইল্যান্ডের এই গাঁজা শিল্প এখান থেকে কোথায় যাবে তা কেউই হয়তো অনুমান করতে পারছে না।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ