বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাত একেবারে নড়বড় হয়েছে গেছে। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের (এসভিবি) পথে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে দেশটির আরও ২০০ ব্যাংক। গ্রাহকদের আমানত তুলে নেয়ার ওপর নির্ভর করছে এই ব্যাংকগুলোর ভাগ্য; এখন সবকিছু নির্ভর করছে আমানতকারীদের ওপর।
এছাড়া টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে ১৮৬টি ব্যাংক। নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য। বাইডেন প্রশাসন সম্প্রতি স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত মার্কিন ব্যাংকিং খাতকে টেনে তুলতে একাধিক পদক্ষেপ নিলেও শঙ্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কে সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন অর্থনীতিবিদের গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে দ্য নিউইয়র্ক পোস্ট ও আরটি জানিয়েছে, প্রায় ২০০টি মার্কিন ব্যাংক পতনের শঙ্কায় রয়েছে। তহবিল তুলে নিতে ব্যর্থ হতে পারে ১৮৬টি ব্যাংক। গুজবে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়া, শেয়ার বাজারে ধস ও সুদের হার দ্রুত বৃদ্ধির কারণে মার্কিন ব্যাংকগুলো এমন বিপর্যয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য অনেক অর্থনীতিবিদের।
তিন দিনের ব্যবধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বিশ্বের আর্থিক খাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সুইজারর্যান্ডের ক্রেডিট সুইস একীভূত হয়েছে আরেক বৃহৎ ব্যাংকের সঙ্গে।
এবার জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের আরও ১৮৬টি ব্যাংক থেকে অর্ধেক আমানকারী যদি দ্রুত অর্থ তুলে নেন, তাহলে সেই ব্যাংকগুলোও বন্ধ করে দিতে হতে পারে। এন জেড হেরাল্ড পত্রতাকর এই প্রতিবেদনে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত বিমা করা থাকলেও এই ব্যাংকগুলোতে বিমাবিহীন আমানতের পরিমাণ অনেক বেশি। সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্রে এনজেড হেরাল্ড বলেছে, এই ১৮৬ টি ব্যাংকের বিমাবিহীন আমানকারীরা আতঙ্কিত হয়ে আমানত তুলে নিতে পারেন।
এ ছাড়া এসব ব্যাংকের সম্পদের বড় একটি অংশ সরকারি বন্ডের মতো অস্থিতিশীল ব্যাংকে রক্ষিত আছে। ফলে সুদহার হ্রাস–বৃদ্ধির কারণে এইসব বন্ড হঠাৎ করে অলাভজনতক হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়।
এসভিবি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কিন্তু এমন নয় যে তাদের পুঁজি কম ছিল বা তাদের অনুল্লেখিত ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। কিন্তু যেসব ব্যাংকের আমানতের সিংহভাগ বিমাবিহীন ছিল, সেগুলোর শীর্ষ এক শতাংশ ব্যাংকের মধ্যে তারা ছিল একটি।
এসভিবি ধসের মূল কারণ একটিই। সেটা হলো, ঝুঁকি অনুধাবনের অক্ষমতা। গত আট মাস এসভিবাতে রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট অফিসার ছিলেন না। তাই ঝুঁকির সঠিক মূল্যায়ন হয়নি, যদিও আপাতদৃষ্টিতে স্থিতিপত্র বা ব্যালেন্স শিট ভালো ছিল।
এ ছাড়া আমানত সঞ্চয়কারীদের জন্য সম্পদ হলেও ব্যাংকের জন্য তা দায়। সে রকম ১৭৫ বিলিয়ন বা ১৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার দায়ের বিপরীতে এসভি ব্যাংক প্রায় সমপরিমাণ মার্কিন সরকারি সিকিউরিটিজ বা বন্ড কিনেছিল, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ। তবে সেগুলোর অধিকাংশই কেনা হয়েছিল কোভিডের সময়, যখন বন্ডের ওপর সুদ ছিল প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কোভিডকালে প্রযুক্তি ফার্মগুলো তাদের বর্ধিত আয় চোখ বন্ধ করে এসভিবিতে রাখতে শুরু করে।
তখন শেয়ারবাজার অনিশ্চিত থাকায় এসভিবি প্রায় সব আমানত সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করে। তখন সেটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হলেও পরের সম্পূর্ণ পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ পোর্টফোলিওতে যে পরিবর্তন আনতে হবে, সে কথা খুব একটা ভাবেননি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) গ্রেগ বেকার।
বন্ডগুলোর বাজারদর ভালো না থাকায় তিনি হয়তো সেগুলোর মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন। সেটিই তাঁর কাল হলো। বাজার গুজব ছড়িয়ে পড়ায় আমানতকারীরা এক দিনে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার আমানত তুলে নেন।
গবেষণার সঙ্গে যুক্ত এক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ‘তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী এই ব্যাংকগুলোতে সরকারি হস্তক্ষেপ বা পুনঃমূলধনের ব্যবস্থা না করা গেলে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি কোনোভাবেই কমবে না।’
এ অবস্থায় উদ্বেগের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, আর্থিক এসব প্রতিষ্ঠান তাদের সম্পদের বড় অংশ সুদনির্ভর মূল্য সংবেদনশীল উপকরণ যেমন—সরকারি বন্ড ও বন্ধকি সিকিউরিটিজের ওপর নির্ভরশীল। ফেডারেল রিজার্ভ গত এক বছরে সুদের হার বাড়ানোর কারণে পুরনো ও কম সুদের বিনিয়োগও মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক এসভিবিও তাদের মূলধন দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ড আকারেই রেখেছিল। একে প্রাথমিকভাবে নিরাপদ হিসেবেই ধরা হয়। তবে এসভিবি যখন বন্ডগুলো কেনে তখন এগুলোর দাম বেশি ছিল।
এদিকে, আতঙ্ক কমাতে আড়াই লাখ ডলারের বেশি যাদের আমানত ছিল তাদেরও সেই ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এতে আমানতকারীরা আশ্বস্ত হতে পারেননি।
এমন প্রতিশ্রুতির পরও ‘এসভিবি সমমানের’ ব্যাংকগুলো থেকে আমানতকারীরা তাদের অর্থ তুলে নেয়া বন্ধ হচ্ছে না বলে নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবে যদি ব্যাংকগুলো আমানত হারাতে থাকে তাহলে সিলিকন ভ্যালির মতোই এসব ব্যাংকও একই পরিস্থিতির শিকার হতে পারে বলে ওই গবেষণায় উঠে আসে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ব্যাংকগুলোর সম্পদের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনাভিত্তিতে সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর বাজারমূল্য আনুমানিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১০২৫
আপনার মতামত জানানঃ