মনুসংহিতায় কলিযুগে ব্রাহ্মণদের জন্য গোহত্যা, অশ্বমেধ এবং নরবলিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই বিধিনিষেধ থেকে এটাই মনে হয় যে, মনুর আগের যুগে অথবা মনুর যুগেও হিন্দুসমাজে নরবলি বেশি না হলেও কিছু কিছু অবশ্যই ঘটত। উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের নামের সঙ্গে জড়িত উপাখ্যান ‘বেতাল-পঞ্চবিংশতি’র সূচনাও একটি কাপালিকের কাহিনীকে অবলম্বন করে হয়েছে বলেই দেখতে পাওয়া যায়।
ভারতে হিন্দুরাজত্বের শেষভাগে, গুপ্তোত্তর যুগে, তন্ত্রধর্মের অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করে থাকেন এবং বামাচারী তান্ত্রিক সাধকেরাই খুব সম্ভবত নরবলিকে আবার শাস্ত্রীয় মহিমায় মণ্ডিত করেছিলেন বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন।
খ্রিস্টীয় বারোশো বা তেরোশো শতাব্দীতে রচিত ‘কালিকাপুরাণ’ গ্রন্থে নরবলিদানের শাস্ত্রীয় আচারগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। উক্ত সময়ে পূর্বভারতের কামরূপ অঞ্চল এ ধরনের তান্ত্রিক সাধনার একটি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং সমগ্র মধ্যযুগ ধরেই তন্ত্রধর্ম বাংলা, আসাম ও উড়িষ্যায় অপ্রতিহতভাবে নিজের রাজত্ব চালিয়ে গিয়েছিল।
সুতরাং সেই তান্ত্রিক কাপালিকদের সাধনার কল্যাণে ঐ যুগে নরবলি ব্যাপারটাও যে খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, এখন সে কথা কল্পনা করে নিলে বোধকরি খুব একটা ভুল হবে না।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘কপালকুণ্ডলা’, কাপালিকদের নরবলিদানের ঐতিহাসিক কাহিনীকে বাংলা সাহিত্য অমর করে রেখেছে। কিন্তু বর্তমান সময় থেকে মাত্র দেড়শো বছর আগেও বঙ্গদেশের নানা জায়গায়, এমনকি ভারতে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী কলকাতার বুকের ওপরও যে মাঝে মাঝেই নরবলির ঘটনা ঘটত, সে কথা শুনলে অনেকেই নিশ্চই এখন শিউরে উঠবেন। সত্যি ঘটনা অনেক সময়েই গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর হয়- এ কথাটা কিন্তু নিতান্তই কোনো প্রবাদবাক্য নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর জনৈক একজন ইংরেজ লেখকের রচনা থেকে জানা যায়, ১৮৪১ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখে পাঞ্জাব প্রদেশে একমাত্র পূর্ণিমা উৎসবেই নাকি ২৪০টি নরবলি হয়েছিল! কিন্তু সেই বিষয়ে সমসাময়িক বঙ্গদেশের কৃতিত্বও নিতান্ত কম ছিল না।
পাদ্রী ‘ওয়ার্ড’ সাহেব তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘View of the History, Literature and Religion of the Hindus’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশের ঠিক কোন কোন জায়গায় নরবলি দেওয়া হতো, সেটার একটি সুদীর্ঘ তালিকা দিয়েছিলেন।
তার সেই তালিকা থেকে জানা যায়, ঐ সময়ে বর্ধমানের কাছে অবস্থিত ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা দেবীর মন্দিরে, মুর্শিদাবাদের করেছে কিরীটকণার কালীমন্দিরে, কাটোয়ার কাছে শ্রীরামপুরের তারামন্দিরে, গুপ্তিপাড়ার কাছে সুরা গ্রামের স্থানীয় দেবীমন্দিরে, নদীয়ার কাছে ব্রাহ্মণীতলায় দুর্গামন্দিরে এবং তমলুকে বর্গভীমার মন্দিরে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও মাঝেমধ্যেই নরবলি হতো এবং সেইসব নরবলির পেছনে আদতে কে বা কারা থাকতেন, সেটা বহু অনুসন্ধান করেও কখনো জানা সম্ভব হয়নি।
ওয়ার্ড লিখেছিলেন, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমল পর্যন্ত নদীয়ায় বহু নরবলি হয়েছিল এবং তখন এই জনশ্রুতিও চালু ছিল, একবার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নাকি জনৈক ব্রহ্মচারীর (কাপালিকের?) পরামর্শে দু-তিন বছরের মধ্যে প্রায় এক হাজার নরবলি দিয়েছিলেন!
‘রেভারেন্ড জেমস লঙ’ সাহেবও ১৮৪৬ সালে ‘Calcutta Review’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে, তৎকালীন বঙ্গদেশের বিভিন্ন জায়গায়, যথা- নদীয়া, শান্তিপুর, বিষ্ণুপুর, সুরা ইত্যাদি জায়গায় নরবলির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
এসব তথ্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই অনেকেরই এ কথা মনে হতে পারে যে, তখনকার খ্রিস্টান পাদ্রিরা হিন্দুসমাজের দোষগুলোর কথা স্বভাবতই কিছু বাড়িয়ে বলেছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবরণগুলো পড়লে তাদের সেই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হতে বাধ্য।
এ প্রসঙ্গে ‘ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ গ্রন্থটি থেকে উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি বিবরণ তুলে দিলেই যথেষ্ট হবে। ১৮২২ সালের ২২ জুন ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, “শোনা গেল যে জিলা নদীয়ার অন্তঃপাতি চাঁদড়া জয়াকুঁড় নামে গ্রামের রূপরাম চক্রবর্তী আড়বান্দা নামে গ্রামে মাঘী পূর্ণিমাতে বলিদান রূপে খুন হইয়াছে। ইহা প্রকাশ হওয়াতে ঐ গ্রামের গৌরকিশোর ভট্টাচার্যের প্রতি সন্দেহ হইয়া তাহাকে কয়েদ রাখিয়াছিল কিন্তু সপ্রমাণ না হওয়াতে সে মুক্ত হইয়াছে।”
১৮২৯ সালের ৪ জুলাই তারিখের ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, “কিয়দ্দিবস হুইল জেলা হুগলির অন্তর্বর্ত্তি কালীপুর গ্রামে এক সিদ্ধেশ্বরী আছেন তাহাকে পূজা করিয়া একদিবস পূজারিরা দ্বাররুদ্ধ করণাত্তর গমন করিয়াছিল পরদিবস তথায় আসিয়া, ঐ পূজারিরা দেখিল যে কতগুলি ছাগ ও এক মহিষ ও এক নর ঐ সিদ্ধেশ্বরীর সম্মুখে ছেদিত হইয়া পড়িয়া আছে ইহাতে তাহারা অনুমান করিলেক যে পূর্ব রজনীতে কেহ পূজা দিয়া থাকিবে, ইহাতে পূজারিরা নরবলি দেখিয়া রিপোর্ট করাতে তত্রস্থ রাজপুরুষ অস্ত্রশস্ত্রাদি সম্বলিত বহুলোক সমভিব্যাহারে তথায় আসিয়া অনেক সন্ধান করিলেন কিন্তু তাহাতে কিছু অবধারিত হয় নাই আমরা অনুমান করি দস্যুদিগের কর্তৃক এরূপ কৰ্ম্ম হইয়া থাকিবে।”
১৮৩৭ সালের ২১ জানুয়ারি তারিখের ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় এর থেকেও রোমহর্ষক নরবলির সংবাদ পাওয়া যায়। “এক দিবস দেবীর (বর্দ্ধমানের নিকট রুক্মিণী দেবী) পূজক ব্রাহ্মণ যথানিয়মে প্রাতঃস্নানাদি সমাধাপূর্বক মহামায়ার অর্চনার্থে মন্দিরের সন্নিকটে গমন করিয়া দেখিলেন যে খর্পরের স্থান রক্তে প্লাবিত চারিপার্শ্বে ধূপ ও ঘৃতের গন্ধে আমোদ করিয়াছে। ইহাতে পুরোহিত অত্যন্ত আশ্চৰ্য হইয়া কুঠুরির মধ্যে প্রবেশ করতঃ আবার বিস্ময়াপন্ন হইলেন যেহেতু ঘরের চারদিকে দেবীকে বেষ্টিত করিয়া রুধির জমাট হইয়াছে। সম্মুখে এক প্রকাণ্ড চিনির নৈবেদ্য এবং তদুপযুক্ত আর ২ সামগ্রী ও একখানা চেলির শাটি তদুপরি এক স্বর্ণমুদ্রা দক্ষিণা এবং প্রায় ১০০০ রক্তজবা পুষ্প তন্মধ্যে নানাবিধ স্বর্ণালঙ্কার তাহাও প্রায় দুই সহস্র মুদ্রার অধিক হইবে।” এরপর পুরোহিত ওই মন্দির পরিষ্কার করে নৈবেদ্য নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। “পরন্তু তাহার দুই চারদিন পরে উক্ত নদ (মন্দিরের নিকটস্থ পুষ্করিণী) হইতে এক মুণ্ডহীন শব ভাসিয়া উঠিল, ইহাতে সুতরাং তত্রস্থ বিচক্ষণরা বিলক্ষণ রূপেই অনুমান করিলেন যে ঈশ্বরীর নিকট ঐ শব বলি হইয়াছিল, কিন্তু পূজার বাহুল্য দেখিয়া সকলে কহিলেন কোনো রাজা আপনার সাধনার নিমিত্ত এ প্রকার ভয়ানক মহাকর্ম সমাধা করিয়াছেন।”
ঐ ভয়ানক ঘটনার পর বর্ধমানের চারটি থানার দারোগা একত্রে এসে অনেক অনুসন্ধান করা সত্ত্বেও প্রকৃত অপরাধীকে কোনোদিনই ধরা সম্ভব হয়নি। এরপর সেই ঘটনা নিয়ে মুর্শিদাবাদের কমিশনারের প্রতি তদন্তের আদেশ হওয়াতে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকাটি আশা প্রকাশ করে লিখেছিল, “এই সন্ধানের ফল জানিবার নিমিত্ত আমরা অত্যন্ত আশাযুক্ত হইয়াছি যেহেতু সাধারণ লোকের মধ্যে এমন জনরব উপস্থিত হইয়াছে যে তথাকার কোনো প্রধান লোক এই নরবলিতে লিপ্ত আছেন এবং আরো জানি এই রুক্মিণী দেবীর নিকট পূর্বেও বিস্তর নরবলি হইয়াছে।”
১৮৩৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা সেই বীভৎস ব্যাপারের উপরে মন্তব্য করে লিখেছিল, ঐ সময়ের সর্বসাধারণের মনে ধারণা হয়েছিল যে, সেই নরবলির কাজটি বর্ধমানের রাজার তরফ থেকেই করা হয়েছিল। উক্ত শতাব্দীতে বর্ধমানের রাজবংশের সঙ্গে যুক্ত কারো কঠিন অসুখ হলে রাজ্যে নরবলির আয়োজন হতো বলে জনশ্রুতি ছিল।
এখানে যে বলির ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, তার কিছুদিন আগে খুব সম্ভবত বর্ধমানে যুবরাজের বসন্ত রোগ হয়েছিল আর হয়তো সেই কারণেই তখন নরবলির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তখন যাকে বলি দেওয়া হতো, তার নাকি তাতে সম্মতি থাকত এবং তাকে তার পিতার একমাত্র পুত্র হতে হতো। উপরোক্ত বলির কিছুদিন আগে থেকেই বর্ধমান রাজবাড়ীর এক বিধবা দাসীর পুত্রের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না (আর কোনোদিন পাওয়াও যায়নি), হয়তো সেই হতভাগ্যকেই ঐ বলির জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোতেও মাঝে মাঝেই ঐ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হতো। ১৭৮৮ সালের ২৪ এপ্রিল তারিখে ‘Calcutta Gazette’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে কলকাতার চিৎপুরের চিত্রেশ্বরীর মন্দিরের একটি নরবলির সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে নরবলি দেওয়ার সময়ে দেবীর অঙ্গ বহুমূল্য বস্ত্র ও সোনা রূপার গহনা দিয়ে সাজানো হয়েছিল এবং শাস্ত্রের আদেশমতো একজন চণ্ডালকেই সেখানে বলি দেওয়া হয়েছিল। শাস্ত্রীয় নির্দেশমতোই পূজার উপযোগী পাত্রাদিও ঐ বলির স্থানে পাওয়া গিয়েছিল। এ থেকে এটাই মনে হয়, সেই বলির পেছনে তখনকার কোনো ধনী এবং শাস্ত্রজ্ঞ লোকের হাত ছিল।
ঐ বিষয়ে তৎকালীন কলকাতার ফৌজদার মন্দিরের পূজারী পুরোহিতকে গ্রেফতার করলেও শেষ পর্যন্ত কিন্তু আসল অপরাধীকে আর কোনোদিনই ধরা যায়নি। চিৎপুরের চিত্রেশ্বরী ও সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দির প্রথম কবে স্থাপিত হয়েছিল, সেটা আজও সঠিকভাবে জানা যায় না। সর্বমঙ্গলা দেবীর নাম বিপ্রদাসের ‘মনসামঙ্গল’ (১৪৯৫/৯৬ খৃষ্টাব্দে রচিত) কাব্যেও পাওয়া যায়।
তবে সতেরোশো’ শতাব্দীর সূচনাতেও বঙ্গদেশে যে ঐ দুটি দেবীর মন্দিরে যথেষ্ট নরবলি হতো, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ১৬৩৭ সালে চিত্রেশ্বরী দেবীর সেবায়েত মনোহর ঘোষের মৃত্যু হয়েছিল। সেই সময়ে ঐ মন্দিরে এত পরিমাণে নরবলি হতো যে, মনোহরের পুত্র ‘রামসন্তোষ ঘোষ’ রোজ সকালে মন্দিরে গিয়ে বহু নরমুণ্ড দেখতে পেতেন এবং একটা সময়ে সেই ভীষণ ব্যাপার অসহ্য হওয়ার জন্যই নাকি তিনি চিৎপুর ছেড়ে বর্ধমানে চলে গিয়েছিলেন। তখন চিৎপুরের চিত্রেশ্বরীর মন্দির ছাড়াও কলকাতার কালীঘাটের কালীমন্দিরেও নরবলি হতো। ওয়ার্ড এবং লঙ উভয়েই তাদের লেখায় কালীঘাটের নরবলির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
ওয়ার্ড বলেছিলেন, ১৮০০ সালে দুজন হিন্দু ঐ কালীমন্দিরে দেবীর কাছে নিজেদের জিহ্বা বলি দিয়েছিলেন। ১৮২৭ সালের ২১ এপ্রিল তারিখের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকাতেও জনৈক পশ্চিমদেশীয় ব্যক্তির কালী প্রতিমার চরণে জিহ্বাদানের সংবাদ পাওয়া যায়। কালীঘাটের নরবলি প্রসঙ্গে লঙ সাহেব ১৮৩২ সালে সেখানে সংঘটিত একটি বীভৎস কাহিনীর উল্লেখ করেছিলেন।
সেবার কালীঘাটের জনৈক হিন্দু, সেখানকার একজন মুসলমান নাপিতকে মন্দিরে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে বলির ছাগলটি চেপে ধরতে বলেছিলেন। নাপিতটি সেকাজ করার পর ঐ হিন্দু ভদ্রলোকটি ছাগলের উপর খাড়া না চালিয়ে সোজা নাপিতের উপরই সেটা চালিয়ে দিয়েছিলেন। এর ফলে তৎক্ষণাৎ সেই নাপিতের মৃত্যু হয়েছিল এবং কিছুদিন পরই সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে গিয়ে সদর নিজামত আদালত ঐ হিন্দু ভদ্রলোকটিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছিল।
১৮৬৫-৬৬ সালেও যশোহর, হুগলী ও বীরভূম জেলায় ভূতপ্রেত, পূজা এবং ভালো শস্য লাভের জন্য মাঝে মাঝেই নরবলির কাহিনী শুনতে পাওয়া যেত। তখন ছোট ছোট ছেলেদের প্রায়ই ঐসব জায়গায় বলি দেওয়া হতো। অবশ্য সেই ধরনের বলি যে তখন খুব বেশি পরিমাণে ঘটত তা নয়।
‘হান্টার’ সাহেব তার ‘Annals of Rural Bengal’ গ্রন্থটিতে ১৮৬৬ সালে যশোরের লক্ষ্মীপাশা গ্রামে কালীমূর্তির সম্মুখে একটি মুসলমান বালকের বলির কথা লিখেছিলেন। ১৮৬৬ সালের ১৯ মে তারিখের ‘Englishman’ কাগজে হুগলী জেলাতেও ঐ ধরনের একটি নরবলির কথা পাওয়া যায়। হান্টার বলেছিলেন, তিনি বীরভূমের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যেও শীঘ্র বৃষ্টিপাত কামনা করে তখন ঐ ধরনের নরবলি দেওয়া হতো বলে শুনেছিলেন।
ছোটনাগপুরের কমিশনার ‘ড্যান্টন’ সাহেব, ১৮৬৪ সালের ২০ অক্টোবর তারিখে সরকারের কাছে জানিয়েছিলেন, ধলভূমের রাজার গৃহদেবী রঙ্কিণীর মন্দিরে মাঝে-মাঝেই নরবলি হয় বলে তিনি সন্দেহ করছেন এবং সেই বলির জন্য কাছের গ্রাম থেকেই বালক সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই বিষয়ের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ধলভূমের রাজাকে গ্রেফতার করা হলেও, আদালতে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণের অভাবে তিনি মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন।
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার প্রসারের ফলে বিংশ শতাব্দী থেকে ভারতে নরবলি প্রথা একরকম উঠে গিয়েছে বললেই চলে, কিন্তু এখনো আসাম, উড়িষ্যা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অঞ্চল থেকেও মাঝে মাঝেই দু-একটি বিচ্ছিন্ন নরবলির সংবাদ পাওয়া যায়।
এমনকি ভারত স্বাধীন হওয়ার মাত্র আট বছরের মাথায়, ১৯৫৫ সালেও, উড়িষ্যার কালিয়াবোধার মঠে পুলিশের খানা তল্লাশির ফলে অনেক গোপন কক্ষ ও নরবলির উপযোগী মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। সাম্প্রতিক অতীতের ও বর্তমানের সেসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে দু-একজন উন্মাদের কাজ মনে করে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু জাতিগতভাবে ভারতীয়রা আজও যে নরবলি দানের অভ্যাস সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেনি, সেটার প্রমাণ এখনো মাঝে-মাঝেই সংবাদপত্রের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়।
এসডব্লিউএসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ