আয়না নিয়ে অনেক গল্পকথা ছড়িয়ে আছে দেশে দেশে। ইংরেজ কবি ও লেখক জিওফ্রে চসারের ‘দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস’ গল্পমালায় আছে টারটারির রাজা কাম্বুস্কানের এমন একটা আয়না ছিল, সেই আয়না দেখে তিনি আগে থেকেই বলে দিতে পারতেন ভবিষ্যতে কী ঘটবে।
‘রেনার্ড দ্য ফক্স’ রূপকথা সিরিজের প্রধান চরিত্র ‘রেনার্ড’ নামের শেয়ালটির কাছেও এমন একধরনের আয়না ছিল। এটা দিয়ে তিনি এক মাইল দূরের জিনিস দেখতে পেতেন। আইরিশ সাহিত্যিক অলিভার গোল্ডস্মিথ তার গল্পে এক আশ্চর্য চীনা আয়নার কথা উল্লেখ করেছেন। এ আয়নার সাহায্যে যে কোনো মানুষের মন ও সেই মুহূর্তে সে কী ভাবছে তা বলে দেওয়া যায়।
আবার শোনা যায়, জাপানিরা দুস্কৃতকারীদের অপরাধের হদিশ পাওয়ার জন্য যখন জিজ্ঞাসাবাদ করতো তখন তাদের মুখের সামনে আয়না ধরতো। সত্যি কথা বা মিথ্যে কথা বলার সময় মুখের যে পরিবর্তন হতো তা তারা আয়নার মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করত।
নিজের মুখটা কীরকম দেখতে তা জানাই যেতো না যদি আয়নার আবিষ্কার না হতো। জলের মধ্যে নিজের ছায়া দেখে মানুষ প্রথম জানতে পারে সে কীরকম দেখতে। তারপর নানা চিন্তা-ভাবনা করতে করতে তারা একদিন আয়না আবিষ্কার করে ফেলে।
এরকম নয় যে আয়না আবিষ্কার করার আগে মানুষ নিজের মুখ দেখতে পারতো না। মানুষ আয়না আবিষ্কারের আগে জলে নিজের মুখ দেখতো। কিন্তু জলে মুখের ছায়া পরিষ্কার দেখা যায় না। যার ফলে জলে নিজেকে দেখে মেকআপ বা সাজগোজ করা সম্ভব না।
জার্মান রসায়নবিদ জাস্টিস ফন লাইবিগ ১৮৩৫ সালে স্বচ্ছ কাঁচের এক পাশে টিন ও পারদের প্রলেপ দেওয়ার একটি কৌশল আবিস্কার করেন। এই কৌশলটিই ছিলো আয়না আবিষ্কারের মূল বিষয়। পরে আরও বড় পরিসরে এবং বাণিজ্যিকভাবে আয়না উৎপাদনের জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজকের আধুনিক আয়নার রূপ আমরা দেখতে পাই।
সেই সময়ে মেটালিক সিলভার দ্বারা তৈরি আয়না শুধুমাত্র ধনী বাড়ির লোকেরা ব্যবহার করত। ধনী ব্যক্তিরা অর্ডার করে নিজেদের জন্য আয়না তৈরি করাতো। কিন্তু দরিদ্র ব্যক্তিরা আগের মতোই জলকেই আয়না হিসাবে ব্যবহার করতো।
সেই হিসাবে ১৮৩৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়না আবিষ্কৃত হয়েছিল। আয়না আবিস্কারের আগে কী মানুষের নিজের চেহারা দেখার প্রয়োজন পড়ত না? সেই প্রয়োজন কিভাবে মেটাত?
১৮৩৫ সালে আনুষ্ঠানিক আয়না আবিস্কারের আগেও মানুষ আয়না ব্যবহার করত। ধরা হয় যে আজ থেকে প্রায় ৮ হাজার বছর আগে আনাতোলিয়া অর্থাৎ বর্তমান তুরস্ক ও মেক্সিকোর মতো দেশে আয়না ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও মিশর, মেসোপটেমিয়ার বা বর্তমান ইরাকের পর চীন দেশেও আদি আয়নার উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সেই যুগের আয়নাগুলো সঠিক চেহারা দেখানোর জায়গায় কেমন এক অদ্ভুত ধরণের চেহারা দেখতো।
প্রাচীনকালের লোকেরা আয়নাকে একটি যাদুকরী জিনিস বলে মনে করত। তারা মনে করতো যে আয়নার সাহায্যে তারা তাদের দেবতা, দেবী ও পূর্বপুরুষদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
তাই সেই যুগের মানুষ আয়নায় তাকাতো তাদের মুখ দেখার জন্য নয় বরং তাদের দেবতা ও পূর্বপুরুষদের সাথে দেখা করার জন্য। সময়ের সাথে সাথে মানুষ আয়না ব্যবহার করতে শিখে গেলেও দরিদ্র শ্রেণির কাছে আয়না দীর্ঘকাল সময় ধরে অস্পৃশ্যই ছিল।
অবশ্য উৎপত্তির শুরুতে আয়নার আদল বর্তমানের মতো ছিল না। স্বচ্ছ কাঁচের আয়নার ধারণা এসেছে আরও অনেক পরে। কাঁচের বদলে তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও রূপার চকচকে পৃষ্ঠকেই আয়না হিসেবে ব্যবহারের চল ছিল।
আয়নার ভেতর আলো প্রবেশ করলে আলোর চরিত্রে কী কী ধরনের পরিবর্তন আসে তা প্রাচীন গ্রিক গণিতজ্ঞ ইউক্লিড সূত্রাকারে লিখে রাখেন। শোনা যায়, আর্কিমিডিস নাকি এ সূত্রের ওপর ভিত্তি করেই অবতল আয়না তৈরি করেন।
রোমান রণতরী যখন সিরাকাস আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছিল তখন তিনি আয়নার ওপর সূর্যের আলো কেন্দ্রীভূত করে কোনো অস্ত্রের সাহায্য ছাড়াই সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমি ফারাসে লাইটহাউসের মাথায় একটা বিশাল আয়না লাগান, যাতে শত্রুপক্ষের জাহাজকে এক মাইল দূর থেকে চেনা যায়।
১৬৬৮ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন টেলিস্কোপ তৈরি করেন। পৃথিবীর সব থেকে বড় ও নিখুঁত আয়না লাগানো আছে ক্যালিফোর্নিয়ার পালামোর পাহাড়ের মাথায় ২০০ ইঞ্চি হেল টেলিস্কোপের মধ্যে। এর ওজন প্রায় সাড়ে চৌদ্দ টন। আর সূক্ষ্মতা হলো দশ লাখ ভাগের এক ভাগ। এ টেলিস্কোপের মাধ্যমে অগণিত আলোকবর্ষ দূরে যেসব মহাজাগতিক বস্তু রয়েছে তা জ্যোতিবিজ্ঞানীরা খুব সহজেই দেখতে পান।
প্রায় ৪০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশর ও মেসোপটেমিয়াতে তামাকে পলিশ করে আয়না হিসেবে ব্যবহার করা হতো।এই জায়গাটি আজ ইরাক নামে পরিচিত। এছাড়া ১০০০ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকায় পাথর পালিশ করে আয়না তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সেটায় অস্পষ্ট চিত্র দেখা যেত।
প্রথম শতাব্দীতে রোমান লেখক প্লিনি দ্য এল্ডার কাঁচ থেকে কাঁচের দ্বারা আয়না তৈরির পদ্ধতি ব্যাপারে লিখেছিল। কিন্তু সেই পদ্ধতিতে আয়না তৈরি করায় তাতে মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না ও আকার-আয়তনে ছোট দেখাচ্ছিল।
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর ১৮৩৫ সালে এমন একটি আয়না তৈরি করা হয় যাতে মুখমণ্ডল স্পষ্ট ও নির্ভুলভাবে দেখা যাচ্ছিল। স্বচ্ছ আধুনিক আয়নায় যে ব্যক্তি প্রথম নিজের মুখ দেখেছিল তার নাম ছিল তেবেলে। ইনি একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষ ছিল।
তেবেলের পরে দ্বিতীয় যেই ব্যক্তি আয়নায় নিজের মুখ দেখেছিলেন তিনি ছিলেন গোষ্ঠীর প্রধান। তার নাম ছিল পুয়া। পুয়া তার মুখ আয়নায় দেখার পর আনন্দে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। আয়নায় তাকিয়ে সে বিভিন্ন ধরণের অঙ্গি-ভঙ্গি করতে শুরু করেছিল। কিন্তু পুয়া আয়নাকে গোষ্ঠীর জন্য, বংশের জন্য বিপজ্জনক বস্তু মনে করেছিল। যার কারণে তিনি আয়নাকে ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন।
আয়না এইভাবে বিভিন্ন মানুষ ও গোত্রের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আজ ধনী থেকে দরিদ্র সকল মানুষ আয়না ব্যবহার করতে পারে। জানিয়ে দিই, যে আয়না হাত থেকে পড়ে বা সামান্য আঘাতে সহজে ভেঙ্গে যায় – তা বানাতে কিন্তু অনেক সময় লাগে। তাই পরের বার যখন আপনি আয়নায় আপনার মুখ দেখবেন তখন জার্মান রসায়নবিদ জাস্টাসকে একটা ধন্যবাদ অবশ্যই জানাবেন।
এসডব্লিউএসএস/১৬৪৫
আপনার মতামত জানানঃ