প্রথমত, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব প্রথম ১৯৬১ সালে গৃহীত হয় এবং ১৯৬৩ সালে পাবনায় পদ্মা নদীর তীরে রূপপুর গ্রামে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সহযোগিতায় ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। পরে একটি রিঅ্যাক্টরের পরিবর্তে দুটি ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রিঅ্যাক্টরের সমন্বয়ে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়, যা বর্তমানে নির্মাণাধীন।
১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশই অর্থায়ন করছে রাশিয়া। প্রকল্পটি বাংলাদেশের পশ্চিম-মধ্য অঞ্চলের পাবনা জেলায় গড়ে তোলা হচ্ছে। রাশিয়ার একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এই প্রকল্পটির নির্মান কাজ পরিচালনা করছে। মোট অর্থায়নের বাকি ১০ শতাংশ প্রদান করছে বাংলাদেশ সরকার। সরকার দূষিত কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্ভরতা কমিয়ে আনার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রূপপুর প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। যেকোনো বৃহৎ প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামোতে ঝুঁকির উপাদান কমবেশি থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশেষ আলোচনায় আসার কারণ হলো পারমাণবিক দুর্ঘটনা অন্য যেকোনো দুর্ঘটনার চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর, ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বিশ্বে অতীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটার দৃষ্টান্ত রয়েছে। চেরনোবিল ও ফুকুশিমা ইত্যাদির কথা বলা যায়। তারপরও বিশ্বের বহু দেশ দুর্ঘটনারোধী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রেখেছে। ঝুঁকি রোধের কার্যকারিতা নির্ভর করে কতটা উন্নত আধুনিক ঝুঁকিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলো এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারে জনবলের কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কত তার ওপর। বাংলাদেশের নিজস্ব কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব এ ক্ষেত্রে একটি দুর্বলতা বটে। যেকোনো দুর্ঘটনাজনিত বা বিপৎকালীন পরিস্থিতিতে পুরোপুরি বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হলে দেশীয় মহলে একটি সংশয় থেকেই যায়।
এর মধ্যেই বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি অর্থ বিভাগে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, অর্থ ও বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান না থাকায় পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানির বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল)। এখনো প্রতিষ্ঠানটির কাছে কয়লার মূল্য বাবদ প্রায় ৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাবে রফতানিকারকরা। বাকি অর্থ পরিশোধ না হলে কয়লা আমদানি করা হবে না বলে জানিয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন (সিএমসি)।
উপসচিব তাহমিনা বেগম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, কয়লা আমদানির অর্থ পরিশোধ না করায় সিএমসির ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং কমে গেছে। এ অর্থ পরিশোধ হলে কয়লা আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বকেয়া থাকায় ১ জানুয়ারি থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ রয়েছে। কয়লা সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে আগামী মার্চ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য অনাদায়ী বকেয়া অর্থ পরিশোধে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করা জরুরি।
বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো বিসিপিসিএলের অপর এক চিঠি থেকে জানা যায়, পায়রায় কয়লা সরবরাহ চুক্তি অনুযায়ী সিএমসি ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়লা আমদানিতে অর্থায়ন করেছে। কয়লা আমদানি বাবদ সিএমসির পাওনা প্রায় ৪৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে ১৮০ দিনের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কয়লা আমদানিতে বকেয়ার পরিমাণ ১৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার। এর মধ্যে ২০২২ সালের অক্টোবরের জন্য প্রায় ৫ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের, নভেম্বরে ৫ কোটি ৮৩ লাখ ও ডিসেম্বরের জন্য প্রায় ৩ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের কয়লা আমদানির অর্থ বকেয়া রয়েছে। এ অর্থের পুরোটা পরিশোধ সাপেক্ষে কয়লা আমদানির বিষয়টি বিবেচনা করবে সিএমসি।
তবে ১৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার বকেয়ার মধ্যে দুটি কিস্তিতে ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার এরই মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিসিপিসিএলের কর্মকর্তারা। সে অনুযায়ী এখনো অন্তত সাড়ে ৩ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে। শুধু কয়লা আমদানি নয়, জটিলতা রয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে নেয়া ঋণের অর্থ পরিশোধের দিক থেকেও। ডিসেম্বরেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণের চতুর্থ কিস্তি পরিশোধ করার কথা ছিল। এটি এখনো পরিশোধ করা যায়নি।
অর্থ ও ডলার সংকটের কারণে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ঋণ ও বকেয়া পরিশোধ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এ অবস্থায় রূপপুরসহ বৃহৎ সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে বিদ্যুৎ বিল, জ্বালানি আমদানি ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে সরকারকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
দেশে গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে বেশ কয়েকটি বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ভিত্তিতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশগুলোর কাছ থেকে এ পর্যন্ত নেয়া ঋণের মোট পরিমাণ সাড়ে ৩ হাজার কোটি ডলারেরও ওপরে। এর বড় অংশই রয়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোয়। আগামী ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে এসব ঋণের বিপরীতে বিপুল অংকের অর্থ পরিশোধ করা শুরু হবে বাংলাদেশের।
১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (প্রথম পর্যায়) নির্মাণ হয়েছে চীনা বিনিয়োগে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২০১৮ সালের ১২ মে চীনের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে ১৯৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের ঋণ চুক্তি করে বিসিপিসিএল। এর মধ্যে নেয়া হয়েছে ১৮৮ কোটি ১৩ লাখ ডলার ঋণ নিয়েছে। চার বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণের মেয়াদ ১৫ বছর। ২৩টি অর্ধবার্ষিক কিস্তিতে এ ঋণ পরিশোধের কথা। এক্ষেত্রে সুদহার ধরা হয়েছে ছয় মাস মেয়াদি লাইবরের (লন্ডন ইন্টারব্যাংক অফারড রেট, বর্তমানে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ) সঙ্গে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ যোগ করে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের মে মাসে। একই বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরু করে দ্বিতীয় ইউনিট। ২০২১ সালের জুনে বিসিপিসিএলের মাধ্যমে ঋণের প্রথম কিস্তি শোধ করা হয়। এরই মধ্যে তিন কিস্তিতে ২০ কোটি ১০ লাখ ডলার পরিশোধও হয়েছে। ঋণের চতুর্থ কিস্তি ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলার ডিসেম্বরে পরিশোধ করার কথা ছিল, যা এখনো বকেয়া রয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এখন চীনের এক্সিম ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা আছে। ঋণের বিপরীতে সরকারের সভরেন গ্যারান্টি দেয়া আছে ৫০ শতাংশ। বিসিপিসিএলের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭০৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা (প্রায় ১৬৮ কোটি ডলার)। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩৮৪ কোটি ২০ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৩২৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। গত অর্থবছরে কোম্পানিটি প্রায় ১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এ সময় কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অবশ্য চুক্তি অনুযায়ী এ লোকসানের অর্থ বিপিডিবির পূরণ করে দেয়ার কথা। চলতিটিসহ দুই অর্থবছরের মধ্যে এ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।
বিসিপিসিএলের পরিচালক এবং এনডব্লিউপিজিসিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী এএম খোরশেদুল আলম বলেন, ‘দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। কেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি সংস্থানে অর্থের প্রয়োজন। ডলার ও অর্থের সংকটে সেটি এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। বিসিপিসিএলের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।’
পায়রায় এখন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দুটি ইউনিট চালু রয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রটি থেকে দৈনিক ১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০০ মেগাওয়াট জাতীয় গ্রিডে দেয়া হচ্ছে, বাকি ৪০০ মেগাওয়াট দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ও গোপালগঞ্জ এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে।
দেশের ইতিহাসে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে পাবনার রূপপুরে। রাশিয়ার ঋণে নির্মাণ হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাশিয়ার দেয়া ঋণ রয়েছে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার।
২০১৬ সালের ২৬ জুলাই এ ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ২০ বছর। এর মধ্যে প্রথম ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড। অর্থাৎ ২০২৬ সাল থেকে প্রতি বছর দুই কিস্তিতে গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা করে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সময় থেকে ১০ বছরে মোট ১ লাখ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। ২০৩৬ সালের মধ্যে এ ঋণ শোধ হবে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে নেয়া ঋণ হয়তো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে কিছুটা তুলে নেয়া যাবে। যেহেতু এরই মধ্যে কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। সামনে হয়তো আরো বাড়বে। একই সঙ্গে এ খাতে ভর্তুকি কমে গেলে টাকা আসবে, তবে ঋণ পরিশোধে বিপুল পরিমাণ ডলারের সংস্থান হবে কিনা সেটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা হিসাব করে দেখি না অর্থনৈতিক লাভটা কেমন হবে, যেটি বিদেশীরা করে। এটি করা গেলে বাণিজ্যিক ঋণও বড় অর্থে উপকারী হতে পারে।’
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার রামপালে ভারতীয় অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। গত ১৭ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে গেলেও ১৪ জানুয়ারি বন্ধ হয়ে যায়। ডলার সংকটের কারণে কয়লা আমদানিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর ১৫ ফেব্রুয়ারি পুনরায় চালু হয়। সাতদিনের কয়লা মজুদ নিয়ে উৎপাদনে গেলেও এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন অনিশ্চয়তায় রয়েছে। পর্যাপ্ত ডলার ও অর্থের সংস্থান না হলে আগামী এপ্রিলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে অর্থায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার কোটি টাকা (১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার)। বিপিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির সমান মালিকানাভিত্তিক যৌথ অংশীদারত্বে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বিপিডিবি ও এনটিপিসির ইক্যুইটি রয়েছে প্রত্যেক সংস্থার ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা করে। দুই দেশের সমান যৌথ অংশীদারত্ব থাকলেও এ ঋণের কিস্তি পরিশোধের দায়ভার থাকছে পুরোটাই বাংলাদেশের ওপর। এক্সিম ব্যাংকের দেয়া এ ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ১৬০ কোটি ডলারের ঋণ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। সাত বছর পর থেকে ঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ২৭টি অর্ধবার্ষিক কিস্তিতে এক্সিম ব্যাংককে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের সুদহার হবে লাইবরের সঙ্গে ১ শতাংশ যুক্ত করে। এছাড়া ঋণের অব্যবহূত বা ছাড় না করা অর্থের ওপর বার্ষিক দশমিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের এপ্রিলে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নয়াদিল্লিতে এ ঋণচুক্তি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে এ ঋণচুক্তি হয়। ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণচুক্তির এরই মধ্যে আট বছর পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট উৎপাদনে গেলেও এখনো বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনে যায়নি। বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে খুব দ্রুতই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ঋণের কিস্তি শুরু হবে। দেশে বৃহৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে অপারেশন শুরু হয়েছে। অনেকগুলো প্রকল্পের ঋণের কিস্তিও শুরু হয়ে গেছে। আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ বেশির ভাগ বড় প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শুরু হবে বলে অর্থনৈতিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১১২ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। সামনে আরো বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে বলে ইআরডির বিশ্লেষণে দেখা গেছে। এর আগে এত বেশি ঋণ পরিশোধ কখনই করা হয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও ১১৭ কোটি ডলার বৈদেশিক দেনা পরিশোধ করতে হয়েছিল সরকারকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যার পরিমাণ ২০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
ঋণের আকার অনুযায়ী, ২০২৫ সালের পর থেকে কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এসব প্রকল্পের বড় অংশই রয়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতের ঋণ। বাস্তবায়ন শেষে এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক গতি না এলে ঋণ পরিশোধে সরকারকে জটিলতায় পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে আইএমএফের শর্তের কারণে এরই মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমিয়ে এনেছে সরকার। তবে ঘাটতি কমিয়ে অর্থ তুলতে পারলেও দেনা পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থানে চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর নির্মাণ ব্যয়, উৎপাদন ও জ্বালানিসহ সামগ্রিক পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সরকারের লক্ষ্য যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠেছে, সেগুলো দ্রুত উৎপাদনে আনা এবং তার জ্বালানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এরই মধ্যে এলএনজি কেনা হচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ও শিল্পে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন স্বাভাবিক রেখে আসন্ন গ্রীষ্ম, সেচ মৌসুম ও রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখার জন্য জ্বালানি আমদানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা গেলে তার অর্থনৈতিক সুবিধাও পাওয়া যাবে। ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০৫
আপনার মতামত জানানঃ