ঝাড়খণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে আদানির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে। কিন্তু গত বছরই কৃষি জমি নষ্টের অভিযোগ তোলে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কার চাষিরা। গত বছরের জুলাই মাসে এই নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে গ্রামবাসী।
এরপর গত মঙ্গলবার বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ রপ্তানি প্রকল্পের বিরোধিতা করে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে মামলা দায়ের করেছেন পশ্চিমবঙ্গের ৩০ চাষি। আর এতেই বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রকল্পটির বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে এই জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। মামলা করেছেন মুর্শিদাবাদ জেলার ৩০ জন কৃষক এবং মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিডিআর)। গতকাল মঙ্গলবার মামলাটি করা হয়েছে।
আদানির বিরুদ্ধে মামলাটি হাইকোর্টে হলো এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কারচুপিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠী ‘শেয়ারবাজারে কয়েক যুগ ধরে অর্থনৈতিক কারচুপি করেছে’।
তাদের এই প্রতিবেদনের কারণে শেয়ারবাজারে আদানি গোষ্ঠীর সব সংস্থার শেয়ারের দাম মোটামুটিভাবে কমেছে। সংস্থার প্রধান গৌতম আদানির ব্যক্তিগত সম্পদও কমেছে। বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় তিনি তিন থেকে এগারোয় চলে গিয়েছেন।
ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য ঝাড়খন্ডের গোড্ডা জেলায় আদানি গোষ্ঠী ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বানিয়েছে।
এ প্রকল্প ‘আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল-বেজড পাওয়ার প্ল্যান্ট’, অর্থাৎ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নিয়ে ঝাড়খন্ডের পরিবেশবিদেরা অতীতে প্রশ্ন তুলেছেন।
গোড্ডা থেকে বিদ্যুৎ মুর্শিদাবাদের ফারাক্কাসহ উত্তর–পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যাবে। এর জন্য অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুতের তার ফারাক্কা জেলার কিছু গ্রামের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা এবং চেষ্টা করেছে আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী সংস্থা।
বিষয়টি নিয়ে ফারাক্কায় বড় সংঘর্ষ–সংঘাত হয় ২০২২ সালের জুলাই মাসে। ফারাক্কার বেনিয়াগ্রাম ও ইমামনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দারা প্রধানত বিক্ষোভ দেখান। তাঁরা আদানির প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেন।
বিক্ষোভকারীরা গণমাধ্যমকে সে সময় বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি, এ কারণে তারা কাজ করতে দেবেন না। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুব কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা আসিফ ইকবাল।
সে সময় তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় কিছু নেতা–কর্মীও এ বিক্ষোভে অংশ নেন এবং আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বেশ কিছু কর্মীকে হেনস্তা করেন। পুলিশ তাঁদের নিরাপত্তা দেয়।
যুব কংগ্রেস নেতা আসিফ ইকবাল সে সময় বলেছিলেন, বিদ্যুতের তার বসতবাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে ভবিষ্যতে দোতলা বাড়ি করা যাবে না, ফলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
গ্রামবাসীর বক্তব্য ছিল, আদানি গোষ্ঠী তাদেরই ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে যােদর বাড়ির ওপর দিয়ে তার যাচ্ছে। আম ও লিচুবাগানের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের তার গেলেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে না। ঘটনার জেরে ফারাক্কায় বিদ্যুতের লাইন বসানোর কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তাজপুরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর করার কথা আদানি গোষ্ঠীর।
কয়েক বছর আগে ২০১৭ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ভাঙড়ে বিদ্যুতের ‘হাই টেনশন’ তার বসানোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন সেখানকার কৃষক ও বাসিন্দারা। আন্দোলনে কয়েকজন মারা যান, কাজ পিছিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, রপ্তানি আয়ের এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই সম্মিলিতভাবে আদানি গ্রুপ এ পর্যন্ত মূলধন হারিয়েছে ৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। এর ফলে এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির তকমা হারালেন ভারতের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানি। তাকে টপকে আবারও এশিয়ার শীর্ষ ধনীর স্থান দখল করছেন আরেক ভারতীয় ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানি।
কয়েকদিন আগে আদানি গ্রুপের শেয়ারবাজার কারসাজি, অর্থপাচার আর কর ফাঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেয়ারবাজার বিশ্লেষক সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চের একটি বিশেষ প্রতিবেদন হুলস্থূল ফেলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে।
ভারতীয় শিল্পগোষ্ঠী আদানিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ বলেছে, সংস্থাটি জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। আদানি গোষ্ঠীর দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ এবং যাবতীয় যুক্তি নাকচ করে হিনডেনবার্গ বলেছে, ‘আমরা বিশ্বাস করি জালিয়াতি জালিয়াতিই। এভাবে পৃথিবীর অন্যতম ধনী হলেও তা জালিয়াতিই।’
এদিকে শেয়ারবাজারে আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক দরপতনের পাশাপাশি ভারতের ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে চরম উদ্বেগ। কারণ ব্যাংকগুলোতে প্রতিষ্ঠানটির বিপুল অঙ্কের ঋণ রয়েছে।
আলোচিত এই আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের। আগামী মার্চ মাসে এ বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে। হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনের জেরে আদানি গ্রুপের মূলধন কমে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে এ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে এলে জ্বালানির ব্যয় হিসেবে বড় ধরনের বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে আদানির।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদ্যুতের দাম ও ক্যাপাসিটি চার্জ তুলনামূলক বেশি বলে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশে আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ রপ্তানি প্রকল্পের বিরোধিতা করে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলা দায়ের করেছে পশ্চিমবঙ্গের ৩০ চাষি। আর এতেই বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ