মাহবুব আরিফ কিন্তু
বিজ্ঞানের আলোকে একজন শিশুকে আলোকিত করতে শিশু মনের উপর ধর্মের জটিল বিষয়গুলো চাপিয়ে না দিলেই কি নয়? একজন শিশুকে তার নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে সহযোগিতা করাই হচ্ছে শিশুর প্রতি মানবিক আচরণ। বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো শিশুকে অনুধাবন করার সুযোগ দিতে হবে।
একজন শিশু বাস্তবতা ও চোখের সামনে যেটা দেখে সেটাই বিশ্বাস করে, যেটা দেখা যায়না সেটা তার চিন্তার খোরাক হয় না। কাল্পনিক কোন বিষয়কে একজন শিশু তার নিজের মতো করে চিন্তা করে। যদি সেটা আমরা জোর করে তার মনের ভেতরে ঢোকাবার চেষ্টা করি তবে তা শিশু মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এগুলো আমার মনগড়া কোন কথা নয়। সিগমন ফ্রয়েড, এরিকসন ও মলারের মতো শিশু বিশেষজ্ঞরা সকলেই একই কথা বলে গেছেন। যারাই চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করেছেন তারা সকলেই জানেন যে শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা ভাবনায় বিষয়গুলো কি ভাবে কাজ করে। আমাদের দেশের বিশিষ্ট মনস্তাত্ত্বিক পণ্ডিতরাও একই কথা বলবেন।
শিশুদের অনুসন্ধানী মনকে ধমক আর শাসন দিয়ে চাপিয়ে রাখলে তা শিশুদের আত্মসম্মানে আঘাত করে। আমাদের উচিত একটি শিশুর পারিপার্শিক পরিবেশ যতটা সম্ভব সুস্থ ও সন্দর করে সাজিয়ে রাখা। যেন শিশুটি সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠে। একজন যোগ্য অভিভাবক হিসাবে এটা আমাদের কতর্ব্য।
ধর্ম বিষয়টি একজন শিশুর মনে নেহায়েত একটি কাল্পনিক বিষয়- যা শিশু মনে ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি না। ধর্ম শিশুদের জন্যে জটিল ও কাল্পনিক একটি বিষয় যেটা ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধারণ করার ক্ষমতা একজন শিশুর নাও থাকতে পারে। ধর্ম নিয়ে আমাদের পরকালের দোযখে যাবার ভয় থাকতে পারে! কিন্তু একজন শিশু ভয় পাবে অন্ধকারকে; কারণ অন্ধকারে সে তার মাকে খুঁজে পায়না। কাজেই শিশুকে কোন কাল্পনিক বিষয় জোর করে তার মাথায় প্রবেশ করানো অন্যায়। একজন শিশু যখন ধর্ম বুঝতে পারবে তখন সে নিজেই বিচার বিবেচনা করে তার ধর্মকে বেছে নেবে। আর না নিলেই বা ক্ষতিটা কোথায়, একজন শিশু তো অমানুষ হয়ে যাচ্ছে না। একজন শিশুকে মানবতা শেখাতে পারলেই যথেষ্ট নয়কি?
স্কেন্ডেনেভিয়ার স্কুল কারিকুলাম থেকে শিশুদের জন্যে বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেবার বিষয়টি সরকারী ভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মানবাধিকার ও মানবতা প্রাকৃতিক শিক্ষা বিষয়টি জানা প্রতিটি শিশুর জন্যে একটি অধিকার। রাষ্ট্রের বিধান মেনেই অভিভাবকরা শিশুদের লালন পালন ও শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কেউ চাইলেই শিক্ষার নামে শিশুদের উপর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন চালাতে পারে না।
সামান্য একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারি আমরা- প্রতিটি অভিভাবক তার সন্তানদের প্রকৃত মানুষ হিসাবে তৈরি করতে কি পরিমান অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু হায়! কতজন অভিভাবক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেই স্বপ্নকে সার্থক করতে পেরেছেন? প্রশ্ন আসতে পারে, এ ক্ষেত্রে কার ভূমিকা কতটুকু? সরকারের করণীয় কি ? নাগরিক দায়িত্ব কতটুকু? ধর্ম এ বিষয়ে কি বলছে? এত সব চিন্তা করতে গেলে সত্যি আমাদের সবারই যখনই পাগল হয়ে যাবার উপক্রম হয়- ঠিক তখনই আমাদের সেই চিন্তার শূন্যস্থান পূরণ করতে খুবই নীরবে ধর্ম তার জায়গা করে নেয়। আসলেই কি ধর্ম এই সব জটিল সমস্যার সমাধান দিতে পারে? ধর্ম কি অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এনে দিতে পারে? সন্তান মানুষ করতে গেলে যে অক্লান্ত পরিশ্রম, শিক্ষা, আর জ্ঞানের প্রয়োজন হয় বাস্তবতার দৃষ্টিতে ধর্ম কি তার সমাধান দিতে পারে? তার একমাত্র সমাধান হচ্ছে নাগরিক ও সমাজ ব্যবস্থার যৌথ সমন্বয়ে একটি সুন্দর ও সঠিক পথকে বেছে নেয়া। আর এক্ষেত্রে আমাদের ও সরকারের যৌথ পরিকল্পনা নিয়ে একত্রে এগিয়ে আসতে হবে। একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই সুন্দর সমাজ আর সুস্থ ও সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ।
আমরা কেউই চাইনা আমাদের সন্তানরা কখনোই মিথ্যা বলবে, মিথ্যাকেকে বিশ্বাস করবে। আমার চাই আমাদের সন্তানেরা সুন্দর চিন্তা করবে। তাদের মাঝে আত্মসম্মানবোধ ও মানবতা বোধ থাকবে। আমাদের দেশের শিক্ষা নীতিমালায় ধর্মীয় শিক্ষা হচ্ছে একটি ধারা। কেউ কি কখনো প্রশ্ন করেছি সেই শিক্ষা ব্যবস্থা কি ভাবে চলছে? কতটুকু বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও মানবতা সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত? ধর্ম শিক্ষা শিশু মনে কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে?
আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার জীবন থেকে একটি ঘটনা আপনাদের আজ বলে শোনাই। আমার বয়েস তখন বড় জোর আট কি নয়। প্রতিদিন ভোরে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণে আমাকে মসজিদে বড় হুজুরের কাছে পাঠানো হতো, আর সেখানে আমাকে প্রায় প্রতিদিনই ধর্মীয় শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে দোজখের বীভৎস বর্ণনা শোনানো হতো। এসব শুনে আমি ঘরে এসে সারাটাদিন একটা আতঙ্কের মাঝেই দিন কাটাতাম। রাতের বেলা ঘুমাতে গেলেই মনে হতো আমার দুই কাঁধে কারা যেন বসে বসে আঁকিবুঁকি করছে। নানান চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারতাম না। চোখের সামনে সাপ আর আগুনের বীভৎস সব কাল্পনিক চিত্র ভেসে বেড়াতো। আমার ভেতরে দিনদিন একটা অপরাধ বোধ জায়গা করে নিলো। এখানে আমি আজ কার দোষ খুঁজে বেড়াবো? এর জন্যে আমি কাকে দায়ী করবো? আমার পিতা-মাতাকে, নাকি আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে? জ্ঞান বুদ্ধি হবার পর এই দুর্গতি থকে মুক্তি পেতে আমাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
একজন পাঁচ বছরের শিশুকে হঠাৎ করেই বিশালাকৃতির কালী মূর্তির সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে সেই শিশুটির মানসিক অবস্থা কি হতে পারে? একটু চিন্তা করে দেখুন….!
মন দিয়ে একটু চিন্তা করে দেখুন তো মানুষ হত্যা, শিশু হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সাধারণ মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক হত্যা, ব্লগার হত্যা, গুম করে হত্যা, দলীয় স্বার্থ সিদ্ধিতে নির্দেশনা দিয়ে বাসে, গাড়ীতে আগুন দিয়ে, পেট্রল বোমা মেরে শত শত মানুষ হত্যা সেই সাথে আত্মহত্যা, নারী ও শিশু ধর্ষণ, শিক্ষক দ্বারা ছাত্র-ছাত্রী ধর্ষণ, পশু ধর্ষণের মত জঘন্য রকমের মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড আজ বাংলাদেশে এক সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। ধর্ম কি আমাদের এসব ব্যাধি থকে মুক্ত করতে পেরেছে ? যদিও প্রতিটি ধর্মেই মানবতার আবেদন পরিপূর্ণ থাকার কথা বলা হলেও আসলেই কি তা লেখা আছে?
আমাদের সন্তানরা আজ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে? কি পরিমাণ মানবতার শিক্ষা পাচ্ছে? শুধু নিজের সন্তানের কথা ভাবলেই হবে না, একটু ভেবে দেখুন তো- বর্তমানে পৃথিবীতে কত শিশু প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে! আসলে আমাদের যেটা প্রয়োজন সেটা অনেকেই অন্তর থেকে অনুধাবন করলেও বাস্তবে সেই কথাটি জোর গলায় বলতে সাহস পাই না। ধর্মগুরুরা ধর্ম গেল, ধর্ম গেল বলে আকাশ-বাতাস মাতিয়ে তুলবেন।
কথাটা হচ্ছে আমাদের সন্তানদের জন্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবতা নামে একটি নতুন বিষয় সংযুক্ত করা উচিৎ। আর ধর্মীয় শিক্ষাকে শিশুদের জন্যে সম্পূর্ণ রূপে বাদ দেয়া উচিত যা কিনা স্কেনডেভেনিয়ার দেশগুলোতে কার্যকরী হতে যাচ্ছে। আমরা তা পারবো কি?
আমাদের উপমহাদেশে ধর্মীয় উন্মাদনার অন্তরালে আমরা আজ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছি। এত কিছু ভাববার সময় কোথায়? রাজনীতির মাঠে ধর্ম একটি প্রধান ট্রাম্প কার্ড, আর এটার উপর নির্ভর করেই পৃথিবীতে চলছে অসুস্থ রাজনীতি। অসুস্থ রাজনীতি অসুস্থ সমাজ তৈরি করে সেই অসুস্থ সমাজে মানবতা ও মানবিক মূল্যবোধ হ্রাস পেতে থাকে। আমাদের মনের অজান্তেই দিনে দিনে একটি জাতি যেখানে তার মানবিক চেতনা বোধকে হারিয়ে ফেলে, সেখানে মানুষই মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলাটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে ধরে নেয়। একজন শিশুকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার মতো সামাজিক ব্যাধি বা মহামারী থেকে আমাদের রক্ষা করবে কে? সামাজিক অবক্ষয় থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হলে এবং একটি সুন্দর সমাজ তৈরি করতে শিশুদের কাল্পনিক ধর্মীয় শিক্ষা বিষয়ে ভাবতে হবে। এখনি পদক্ষেপ না নিলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সভ্যতা থেকে আমাদের অনেক পিছিয়ে যেতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ