পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ার পর খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি আজ। ছয়টি বিতরণ কোম্পানির দেয়া ২৪ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
তবে বিইআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিদ্যমান জ্বালানি বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় গ্রাহক বা খুচরা পর্যায়ে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে।
বিইআরসির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, বিতরণ কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রস্তাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছে কমিশনের কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি)। টিইসি তাদের প্রস্তাব তৈরি করেছে। যৌক্তিক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে তারা।
এক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ আসতে পারে। যদিও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত কিছু নয়। গণশুনানিতে সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন।
এছাড়া বিইআরসির এক সদস্য নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে গতকাল বলেন, ‘গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়বেই। তবে সেটি যৌক্তিক পর্যায়ে থাকবে। সেটি ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে আশা করছি।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই গত ২১ নভেম্বর পাইকারি বিদ্যুতের (বাল্ক) দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ায় কমিশন। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ২০-২৪ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বাড়াতে কমিশনে প্রস্তাব পাঠায় বিতরণকারী কোম্পানিগুলো।
আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে গণশুনানি হবে। শুনানি কার্যক্রম শেষ না হলে আগামীকালও শুনানি চলবে। এদিকে একই দিনে একই জায়গায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ট্যারিফের ওপরও শুনানি করবে কমিশন।
সংস্থাটি জানায়, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) বিদ্যুতের সঞ্চালন ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাবের আবেদনের ওপর এ শুনানি হবে।
এর আগে গত বছরের জুনে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এরপর আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম ৪২-৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যায়।
এক্ষেত্রে জনজীবনে ব্যাপকভাবে তার প্রভাব পড়ে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১০-১৫ শতাংশ বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব ধরনের পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সরকার বাজেট থেকে ব্যয় নির্বাহ করবে। অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়ে তা ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করা বেআইনি বলে মন্তব্য করেন তারা।
কনউিজমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট মো. গোলাম রহমান বলেন, বিদ্যুতায়ন সরকারের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় যদি বেড়ে যায় তার খরচ বহন করতে হবে বাজেট থেকে। এ ব্যয় কমাতে ভোক্তার কাছ থেকে খরচ তোলার জন্য সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে না। এটি কোনো প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না।
জানা যায়, দাম পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে এবার ভর্তুকি ধরা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ দাম বাড়ানোর পরও বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যায়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেবে সরকার।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির লোকসান বাড়ছে দিন দিন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তাদের লোকসান ছিল ১১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক ক্ষতি ৩১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ কারণে বিইআরসিতে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ১৭ থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করে কমিশন। নতুন এ দাম গত ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছিল ১০৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গ্রাহক পর্যায়ে সর্বশেষ দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে সময় বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এর আগে ডিসেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বেড়েছিল। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি। সংস্থাগুলো আবেদনে বলেছে, ২০২০ সালের পর খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয়নি, এরমধ্যে বিভিন্ন খাতে খরচ বেড়েছে। এখন পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কারণে তাদের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তাই পাইকারির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়াতে হবে। দাম বাড়ানোর প্রভাব নিয়ে তারা বলেছে, গ্রাহক ব্যবহারে সাশ্রয়ী হলে তাদের মাসের খরচ বাড়বে না। তাছাড়া ধনী গ্রাহকরাও বাড়তি বিল এড়াতে সাশ্রয়ী হবেন বলে তাদের ধারণা।
তবে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মানুষ কষ্টে আছে। এই অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে নিত্যপণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। সবমিলে দাম বাড়ানোর বিকল্প ভাবা উচিত।
কমিশন সদস্য (বিদ্যুৎ) বজলুর রহমান শনিবার বলেছেন, বর্তমান কমিশনের মেয়াদ আগামী মাসে শেষ হবে। তাই শুনানির পর বেশি সময় নেওয়া হবে না। এ মাসের মধ্যেই বিদ্যুতের দাম নিয়ে আদেশ ঘোষণা করা হবে।
কমিশন গত ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়িয়েছিল। নতুন এ দাম ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। দাম বাড়ানোর দুই দিনের মাথায় ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর আবেদন করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে বাকি পাঁচটি কোম্পানি আবেদন জমা দেয়। এরপর সবার আবেদন যাচাই-বাছাই করতে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে দেয় কমিশন।
সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা ভোক্তার কাছে ‘মুনাফা না, লোকসান না’ নীতিতে বিদ্যুৎ বিক্রি করার কথা থাকলেও, কেউ কেউ নিয়মিত মুনাফা করে।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির আবেদনে দেখা গেছে, সবচেয়ে বড় বিতরণ কোম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ৫২৪ কোটি টাকা লোকসান করেছে। দাম বাড়ানো না হলে আগামী বছরে এটি আরও বেড়ে যাবে। গত অর্থবছরে ১৬৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। আগের বছর এটি ছিল ১০৭ কোটি টাকা। তবে দাম না বাড়ালে এ বছর লোকসানে যাওয়ার শঙ্কায় আছে তারা।
গত অর্থবছরে ৬৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। আগের বছর তাদের মুনাফা ছিল ৭৬ কোটি টাকা। তবে ডেসকো বলছে, বিদ্যুৎ বিক্রি করে তারা গত বছর লোকসান করেছে। অন্যান্য আয় থাকায় সব মিলিয়ে মুনাফা হয়েছে। গত অর্থবছরে সাড়ে ৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। তার আগের বছর ২৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে তারা। তবে দাম বাড়ানো না হলে এবার আরও বেশি লোকসান হবে।
নর্দার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) বলছে, পাইকারি দাম বাড়ানোয় বছরে ৫৩৫ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। প্রতি ইউনিটে তাদের লোকসান হবে ১ টাকা ১৩ পয়সা। তাই দাম বাড়ানোর আবেদন করেছে তারা। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানি নিট মুনাফা করেছে ৩১ কোটি টাকার বেশি। আগের বছর এটি ছিল প্রায় ১৮ কোটি টাকা।
এর আগে গত ১৪ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯ বার। এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সর্বশেষ দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যা ওই বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সময় খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপর গত ডিসেম্বর থেকে আরেক দফা বাড়ে পাইকারি বিদ্যুতের দাম। এখন বাড়বে খুচরা পর্যায়ে।
তবে দাম বাড়ানোর বিকল্প প্রস্তাব রোববার শুনানিতে তুলে ধরবে ক্যাব। এ সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেছেন, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা রোধ করে বিদ্যুৎ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব। এটি না করে পাইকারি দাম বাড়িয়ে বাড়তি ৮ হাজার কোটি টাকা তোলা হচ্ছে। তা এখন সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে। তবে খুচরা মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো সম্ভব।
এসডব্লিউএসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ