ইউক্রেনে যুদ্ধে সবাই কম-বেশি ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও লাভবান হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা একদিকে যেমন রাশিয়ার দরজার কাছে চলে আসার প্রয়াস পাচ্ছে, তেমনি সারা বিশ্বে অস্ত্র বিক্রি ও ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে তাদের অর্থনীতিতে ফুরফুরে হাওয়া লাগিয়ে বেশ নিশ্চিন্তেই আছে। এদিকে চীন ও উত্তর কোরিয়াও সময় ও সুযোগ বুঝে কোরিয়া সাগর ও চীন সাগরকে উত্তপ্ত করার প্রয়াস পাচ্ছে। মোট কথা, সারা বিশ্বে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে আমেরিকা আজ নিশ্চিন্ত মনে সেই আগুনে আলু পোড়া দিয়ে খাচ্ছে।
এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রি দ্বিগুন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে ন্যাটো দেশগুলোতে যে পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করা হয়েছিল, ২০২২ সালে তা প্রায় দুই গুণ হয়ে গেছে।
২০২১ সালে মোট ১৪টি বড় পর্যায়ের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি সম্পন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র। এর মূল্য ছিল ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার। তবে ২০২২ সালে সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ বিলিয়ন ডলারে। এরমধ্যে আছে ফিনল্যান্ডের কাছে ১.২৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রিও। ফিনল্যান্ড রুশ সীমান্তবর্তী একটি দেশ এবং ন্যাটোর সম্ভাব্য নতুন সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ম্যাগাজিন ফরেন পলিসিতে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবেই ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে প্রধান অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। উল্টো ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা শিল্পে যে অতিরিক্ত চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তাও যোগান দিচ্ছে ওয়াশিংটন।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রেক্ষিতে নিজেদের অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। যদিও ২০২২ সালে সম্পন্ন হওয়া চুক্তিগুলোর কয়েকটি আগে থেকেই আলোচনায় ছিল। তবে রাশিয়ার অভিযান ন্যাটো সদস্য দেশগুলোকে নতুন করে ধাক্কা দিয়েছে।
এছাড়া ইউক্রেনকে দুহাত খুলে অস্ত্র পাঠাচ্ছে ন্যাটো দেশগুলো। ফলে নিজেদের অস্ত্র ভাণ্ডারেও টান পড়েছে। সেটি পুরনেই যুক্তরাষ্ট্রের উপরে বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের। লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং এস্তোনিয়া হাইমার্স রকেট লঞ্চার সিস্টেম অর্ডার করেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
এছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর পোল্যান্ডের কাছে ১১৬টি এম১এ১ আব্রাহাম ট্যাংক বিক্রি অনুমোদন করেছে। এর আগে পোল্যান্ড নিজেদের সোভিয়েত আমলের পুরোনো ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠায়।
সম্প্রতি ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের কেন্দ্রীয় বিলে স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এরমধ্যে ৮৫৮ বিলিয়ন ডলারের রেকর্ড পরিমাণ অর্থ নির্ধারিত হয়েছে প্রতিরক্ষার পেছনে। মার্কিন সিনেট কমিটির প্রকাশ করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে মোট ৪৫ বিলিয়ন ডলারের জরুরি সহায়তা দেয়া হবে এই বাজেট থেকে।
২০২২ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর রাশিয়াকে হারাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ইউক্রেনকে শুধুমাত্র সামরিক সহায়তাই দিয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
উল্লেখ্য, সারা বিশ্বে যেমন আধিপত্য ও অস্ত্র বিক্রির মদদদানকারী হিসাবে পরিচিত আমেরিকা একে একে পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, এমনকি সুইডেনকেও ন্যাটোভুক্ত করেছে, তেমনি ইউক্রেনকেও চাইল ন্যাটোভুক্ত করতে। যদিও ব্যতিক্রমী প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প একসময় চেয়েছিলেন ধীরে ধীরে ন্যাটো ভেঙে দিতে। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর তিনি যথার্থই মনে করেছিলেন, আর এখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের দরকার নেই। কারণ ন্যাটোর সামরিক ব্যয়ের সিংহভাগই আমেরিকা জোগান দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এসে আবার তার পূর্ববর্তীদের পথই অবলম্বন করতে থাকেন।
পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলো এখন রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভর না করে মার্কিন এলএনজি (তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ক্রয় করছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এসব তথ্য জানিয়েছেন।
আনাদোলু এজেন্সির প্রতিবেদন অনুসারে, ‘রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে ইউরোপ এখন কেবল রুশ গ্যাসের ওপর নির্ভরতা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি-র ওপর নির্ভরতার দিকে চলে গেছে।’
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে লাভবান হচ্ছে ওই বিষয়ে রসিয়া-১ টিভির সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘মার্কিন এলএনজি (তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ক্রয় করে ইউরোপ এবার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। কিন্তু, এ সম্পর্কে তেমন পারস্পরিক আদান-প্রদান নেই। মূলত, এতে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই লাভ হচ্ছে।’
পেসকভ বলেন, ইউরোপীয়দের রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও হাস্যকর। এটা এক ধরনের পাগলামি। কারণ, ইউরোপের ওই সিদ্ধান্তের কারণে তারা প্রতিদিন বিলিয়ন-বিলিয়ন ইউরো হারাচ্ছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার উপার্জন করছে।
তবে পেসকভ এ কথাও স্বীকার করেছেন যে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক দ্বন্দ্বাত্মক হয়ে উঠেছে।
এসডব্লিউএসএস/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ