রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো ২৭ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। দলগত অবস্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন চতুর্থ। এটিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইতিহাসে অন্যতম বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ কখনোই কোনো নির্বাচনে এত খারাপ ফলাফল করেনি। টানা তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগ রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এত বাজে ফলাফল কেন করলো সেটি রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নৌকা ভাসাতে পারবে, দলের অন্ধ সমর্থক ছাড়া এ কথা কেউ ভাবেননি। কিন্তু নৌকার পরাজয় যে এতটা করুণ ও বিষাদগ্রস্ত হবে, তা–ও অনেকের কল্পনার বাইরে ছিল। দ্বিতীয়বারের মতো রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান।
গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টায় ২২৯টির কেন্দ্রের সব কটির ফলাফল ঘোষণা করা হলে দেখা যায়, লাঙ্গল প্রতীকের এই প্রার্থী পেয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৮ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী (হাতপাখা প্রতীক) আমিরুজ্জামান।
তিনি পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৯২ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) লতিফুর রহমান ৩৩ হাজার ৮৮৩ ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হোসনে আরা লুৎফা (ডালিয়া) ২২ হাজার ৩০৬ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন।
এর অর্থ, আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসেননি, এমনকি জামানত হারিয়েছেন। লাঙ্গল প্রতীকধারী জাতীয় পার্টির প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রার্থীর। এই নির্বাচনে তৃতীয় অবস্থানে আছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
যদিও প্রচারকালে আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকা উন্নয়নের প্রতীক বলে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। ফলাফলে দেখা গেল, লাঙ্গলের সঙ্গে লড়াই করবে কি, হাতপাখার ঝাপটায় কুপোকাত নৌকা।
আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্করা মনে করছেন, রংপুরের ভরাডুবি আওয়ামী লীগের জন্য একটি শিক্ষা এবং এই নির্বাচনের ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথরেখা তৈরি করতে হবে।
আওয়ামী লীগের যে নেতারা কথায় কথায় বিরোধী দলের মধ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র খোঁজেন, তাঁরা কি একবার রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখবেন? কেন এই ভরাডুবি? রংপুরের নাগরিক সমাজের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এই ফলাফলের পেছনে লাঙ্গল ও হাতপাখা প্রার্থীর কৃতিত্ব তেমন নেই; যতটা মানুষের ক্ষোভ আছে নৌকার প্রতি। অথচ, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমদ ভালো ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন।
রংপুরে বিএনপি সব সময়ই দুর্বল ছিল। সেখানে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো নৌকা ও লাঙ্গলের মধ্যে। যেটিতে লাঙ্গল জিতত, নৌকা দ্বিতীয় হতো। যেটিতে নৌকা জিতত সেটাতে লঙ্গল দ্বিতীয় হতো।এবারে আরও দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারেকাছেও নেই।
কেন এমনটি হলো? কেন আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবে না? রংপুরের নেতা-কর্মীদের মতে, আওয়ামী লীগের মনোনয়নই ভুল ছিল। হোসনে আরা লুৎফা একসময় রংপুরে আইনপেশায় যুক্ত থাকলেও গত সংসদে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকে ঢাকায় থাকেন। দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার সংযোগ কম। মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
তাদের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ৩৪ হাজার ভোট পেয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনেক সময় ভাবেন, তারা যাকে মনোনয়ন দেবেন, জনগণ তাকেই ভোট দেবে। মানুষ এখন দলের প্রতীকের চেয়ে এলাকার মানুষের সঙ্গে প্রার্থীর যোগাযোগকে গুরুত্ব দেয়; তিনি যে দলেরই হোন না কেন?
তবে ভুল মনোনয়নই আওয়ামী লীগের ভরাডুরির একমাত্র কারণ নয়। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের ওপর ক্ষমতাসীন দল যে চাপ সৃষ্টি করে আসছে, রংপুরের মানুষ তা ভালোভাবে নেননি। তারা মনে করেছেন, সরকারি দল তাদের প্রয়োজনে জাতীয় পার্টিকে কাছে টেনে নেয়, আবার যখন প্রয়োজন থাকে না দূরে ঠেলে দিতেও দ্বিধা করে না।
এর আগে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা জয়কে সরকারের প্রভূত সাফল্য বলে দাবি করেছিল। কিন্তু বিএনপির দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর সম্মিলিত ভোট হিসাব করলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অনেক কম ভোট পেয়েছেন। নির্বাচন তো কৌশলের খেলা। যে কৌশলেই হোক, আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। কিন্তু রংপুরে এমন নৌকাডুবি হলো কেন?
তাহলে কি গত ছয় মাসে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা অরও কমে গেছে? কোনো দলের জনপ্রিয়তা মাপার যন্ত্র হলো নির্বাচন। কিন্তু বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো দল নির্বাচনে না এলে আমাদের কী করার আছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা হলো সবচেয়ে ঠুনকো যুক্তি।
এসডব্লিউএসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ