বেসরকারি ও নাগরিক সংস্থাগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম সংকুচিত হয়ে বৈশ্বিক স্থায়িত্ব সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আরও নিচে নেমে এসেছে। বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) প্রকাশিত সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনস সাসটেইনেবিলিটি ইনডেক্সের (সিএসওএসআই) বৈশ্বিক প্রতিবেদন ২০২১ অনুসারে, আইনি জটিলতা, মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অর্থায়নের অনিশ্চয়তার মতো চলমান সংকটের সঙ্গে কোভিড পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায় এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বৈশ্বিক এ রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নাগরিক সংগঠনগুলোকে নিবন্ধন ও নবায়ন জটিলতা, অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিলম্বিত অনুমোদন, আমলাতান্ত্রিক হয়রানি, পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা ইউএসএআইডি প্রকাশিত এ রিপোর্টে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের ৭৩টি দেশের তথ্য পর্যালোচনা করে দেশের উন্নয়ন ও নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, সুশাসন ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নাগরিক সংগঠনের ভূমিকার সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়।
২০২১ সালে বাংলাদেশের নাগরিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্থায়িত্বশীলতা সূচক দাঁড়ায় ৪-এ, আগের বছরও এটি একই জায়গায় ছিল। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ এ সূচকের অন্তর্ভুক্ত হয়, ওই বছর এবং ২০১৫ সালে এ সূচক ছিল ৩.৫, যা বাংলাদেশের নাগরিক সংগঠনের জন্য সর্বোচ্চ স্কোর। পরবর্তী পাঁচ বছর (২০১৫-২০) এ সূচকের প্রতিবছর অবনমন ঘটেছে। ২০২১ সালে ৭টি পরিমাপক/চলকের মধ্যে চারটিতে অবনমন ঘটে, ৩টি অপরিবর্তিত ছিল।
অলাভজনক প্রকৃতির আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন ট্রেড ইউনিয়ন সমাজভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, নারী মোর্চা, সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাদার সংগঠন, এনজিও, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক আন্দোলন, গণমাধ্যম, থিংক ট্যাংক ইত্যাদি সিএসও হিসেবে পরিগণিত।
আইনি পরিবেশ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, আর্থিক সামর্থ্য, অ্যাডভোকেসি, পরিষেবা, অবকাঠামো এবং ভাবমূর্তি–এ সাতটি চলক বিশ্লেষণ করে সেগুলোর গড় থেকে সার্বিক সূচক নির্ধারণ করা হয়। এজন্য ১ থেকে ৭ পর্যন্ত একটি পরিমাপক ব্যবহার করা হয়। প্রাপ্ত স্কোরের ভিত্তিতে দেশগুলোকে বিভিন্ন স্তরে ভাগ করা হয়: ১.০-৩.০: স্থায়িত্বশীলতা উন্নত; ৩.১-৫.০: স্থায়িত্বশীলতা বিকাশমান; ৫.১-৭.০: স্থায়িত্বশীলতা বাধাগ্রস্ত। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবছর ইউএসএআইডি এ সূচক করে আসছে।
একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন চলকের বিপরীতে সূচকের প্রস্তাব করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সম্পাদকীয় প্যানেল অধিকতর পর্যালোচনার মাধ্যমে সূচক চূড়ান্ত করে।
২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো থেকে ২০২১ সালে বিদেশি অনুদানের অনুমোদন পেতে বিলম্ব ঘটেছে। এ ছাড়া এনজিও কার্যক্রমে নতুন শর্ত আরোপ করা হয়েছে যা এ ধরনের নাগরিক সংগঠনগুলোকে জটিলতায় ফেলেছে।
বাংলাদেশে সিএসও সেক্টর বহুলাংশে সরকারসহ দেশি-বিদেশি দাতা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। ২০২১ সালে এ সেক্টরের আর্থিক সামর্থ্যের জায়গাটি সামগ্রিকভাবে অপরিবর্তিত ছিল। এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো অনুমোদিত বিদেশি তহবিলের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে বাড়লেও সামগ্রিকভাবে ছাড়কৃত অর্থের পরিমাণ কমে যায়।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, নীতি-নির্ধারণসহ সরকারের কোনো কাজ সমালোচিত হতে পারে এরকম বিষয়ে অ্যাডভোকেসি করতে নাগরিক সংগঠনগুলো সাধারণত দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। পাশাপাশি ইতিবাচক মিডিয়া কাভারেজ কম থাকায় সাধারণ মানুষের কাছে নাগরিক সংগঠনগুলোর শক্তিশালী ভাবমূর্তি তৈরি হয়নি।
রিপোর্টে বলা হয়, তহবিল সংকট, যোগ্য কর্মীদের ধরে রাখতে না পারা ইত্যাদি কারণে ২০২১ সালে নাগরিক সংগঠনগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার কিছুটা অবনমন ঘটেছে।
বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ-কাঠামোসহ সামগ্রিক আইনি পরিবেশ নাগরিক সংগঠনের কার্যক্রমকে সীমিত করে। ফলে আইনি পরিবেশের ক্ষেত্রে স্কোর কিছুটা কমে যায়।
তথ্য ও মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা নাগরিক সংগঠন বিশেষ করে গণমাধ্যমের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। আগের বছরগুলোর মতো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করে। ২০২১ সালেও এ ধারা অব্যাহত ছিল।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ২০২১ সালেও বরাবরের মতো উদ্বেগের বিষয় ছিল। নাগরিক সংগঠন ও গণমাধ্যম অবাধে তাদের তাদের কাজ করতে পারেনি। অ্যাডভোকেসির জায়গাতেও নাগরিক সংগঠনগুলোর স্কোরের অবনমন লক্ষ্য করা যায়।
নাগরিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সরকারি বিভাগের অধীনে নিবন্ধিত। দেশে এ ধরনের কত প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বিভিন্ন উন্মুক্ত সূত্রের বরাত দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে ৫৮ হাজারের বেশি সংগঠন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে ১৫ হাজারের বেশি সংগঠন, শ্রম অধিদপ্তরের অধীনে ৯ হাজার ট্রেড ইউনিয়ন এবং এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর অধীনে ২,২৬১টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত রয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ