নিঃসঙ্গতায় মৃত্যু হচ্ছে মানুষের। দেহ পচে গন্ধ বের হলে তবেই খবর পাচ্ছে সমাজ। অনেক ক্ষেত্রেই আত্মীয়রা নয়, মৃতের শেষকৃত্য করছে প্রশাসন। যেহেতু কেউ নেই! এই নিকটজন না থাকাই এমন মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণ, বলছেন চিকিৎসকরা।
দেশে হাজার হাজার মানুষের ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’ নিয়ে উদ্বিগ্ন দক্ষিণ কোরিয়া। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, স্থানীয় ভাষায় ‘কোডোকসা’ বা ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’ বছর বছর বেড়ে চলেছে।
দক্ষিণ কোরিয়া প্রশাসন জানাচ্ছে, হয় বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করছেন অথবা অসুস্থ হয়ে অবহেলায় মৃত্যু হচ্ছে বহু মানুষের। কারণ কেউ দেখার নেই ওদের। লাশ পচলে খবর পাচ্ছেন প্রতিবেশী। বিষয়টি নিয়ে দেশটির সরকার এতটাই চিন্তিত যে তা ঠেকাতে আইন এনেছে সরকার।
ইঁদুর দৌড়ের পৃথিবীতে একান্নবর্তী ভাবনা অলিক। ছোট হয়ে আসছে পরিবারের আকার। একাধিক কারণে ভিন্নরূপে ফিরে আসছে জঁ পল সাত্রের মহাবচন “দ্য আদার ইজ হেল।”
নতুন প্রজন্মের একটি অংশ স্বার্থপরের মতো অস্বীকার করছে আত্মীয়দের। বয়স হলে সেই তারাও নিঃসঙ্গ মৃত্যুর কবলে পড়ছে।
এই সময়কে বলা হচ্ছে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ আর ‘কানেকটিভিটির’ যুগ। হাতের মুঠোয় ফোন আর নানা গেজেটে সারাক্ষণই বিভিন্ন নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকছি আমরা। কিন্তু এই সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কতটা দূর হচ্ছে ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা! গবেষণা বলছে, সামাজিক পরিসরের নিঃসঙ্গতা আধুনিক মানুষের এক নীরব ঘাতক। কেবল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যই নয় শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে নিঃসঙ্গ জীবন।
নতুন এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দীর্ঘ জীবন সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চাইলে, সমাজে থেকেও না থাকার, দীর্ঘ সময় ধরে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করার অভ্যাসটি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া প্রশাসন জানাচ্ছে, হয় বিষাদগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করছেন অথবা অসুস্থ হয়ে অবহেলায় মৃত্যু হচ্ছে বহু মানুষের। কারণ কেউ দেখার নেই ওদের। মরা পচলে খবর পাচ্ছেন প্রতিবেশী। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’ হয়েছে ২,৪১২ জনের। গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৩,৩৭৮।
প্রশাসনের বক্তব্য, কোভিড মহামারি আমলে সমান্তরাল মহামারী হয়ে উঠেছে ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’। যে কারণে মৃত্যু বাড়ছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের সেগুলি হল সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দারিদ্র্য এবং জনসংখ্যাগত সংকট।
আধুনিক যাপন ক্রমশ দামী হয়ে ওঠায় সন্তান নিচ্ছেন না অনেকেই। কেউ কেউ আবার ভাগদৌড়ের জীবনে আরও আরও বেশি আয়ের খোঁজে এত ব্যস্ত যে বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদু-ঠাকুমাকে সময় দিতে পারছেন না।
জানা গিয়েছে, ‘নিঃসঙ্গ মৃত্যু’ হচ্ছে যাদের, তাদের ৬০ শতাংশের বয়স পঞ্চাশ বা ষাটের কোটায়। যদিও চল্লিশ, এমনকী সত্তরের কোটায় পৌঁছানো মানুষও খুনি নিঃসঙ্গতার পাল্লায় পড়ে মারা যাচ্ছেন।
পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে ওঠায় ‘লোনলি ডেথ প্রিভেনশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০২১’ এনেছে দক্ষিণ কোরিয়া প্রশাসন। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নিঃসঙ্গ মৃত্যু ঠেকাতে একাধিক ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন।
এই বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে দেখছেন দেশটির বিশেষজ্ঞরা। যদিও জীবন যাপনে পরিবর্তন না আসলে, বিলাসিতা থেকে না সরলে ভবিতব্য বদলাবে না মানুষের। হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন সমাজবিদ ও মনস্তত্ববিদরা।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমীক্ষা থেকে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবনযাপনের নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয় এই গবেষণায়। সবক্ষেত্রেই মনোযোগ ছিল সামাজিক পরিসরে নিঃসঙ্গতা, একা একা বসবাস করা এবং ব্যক্তির মানসিক একাকিত্বের বিষয়টি। এতে দেখা যায়, সামাজিক পরিসরে যোগাযোগহীন থাকার সঙ্গে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা বেড়ে যাওয়ার যোগ আছে। আবার, সামাজিক জীবনযাপন এবং ইতিবাচক সম্পর্কের মধ্যে থাকাটা ব্যক্তির মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী, একাকীত্বের আক্রমণ মধ্যবয়স বা প্রৌঢ়ত্বের তুলনায় বয়ঃসন্ধিতে বেশি। আঠারো বছর বয়সের নাগরিকদের সত্তর শতাংশেরও বেশি একাকীত্বে ভোগেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে কাজ করা একটি মার্কিন সংস্থা সিগনার ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আঠারো থেকে বাইশ বছর এবং তেইশ থেকে সাঁইত্রিশ বছর বয়ঃসীমায় থাকা মানুষদের ক্ষেত্রে এর প্রকোপ বেশি। আমাদের দেশেও এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অবসাদ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, হৃদরোগ, স্নায়ুরোগের মতো অজস্র মানসিক ও শারীরিক ব্যাধি।
এই যে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তীব্র হয়ে উঠছে একাকীত্ববোধ আর বিচ্ছিন্নতা; এর বড় কারণ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি। এতে সময় কাটে ঠিকই। কিন্তু কাছের মানুষগুলোর সাথে বাড়ে অমোচনীয় দূরত্ব। একাকীত্ব ঘোচে না। আর এভাবে দিন দিন তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার অক্ষমতা। ফলাফল নিঃসঙ্গ মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশি নিঃসঙ্গ হতে থাকেন।
সামাজিক যোগাযোগ যাদের কম, তাদের মস্তিষ্কে এমন পরিবর্তন আসে, অন্য মানুষের চেহারা দেখলেও তাদের মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়। ফলে অন্যদের সঙ্গে আলাপচারিতা ও সম্পর্ক গড়ে ওঠা ক্রমেই আরো দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়, সামাজিক যোগাযোগের অভাব মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই নিঃসঙ্গ মানুষের অকাল মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেশি।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, একাকীত্ব হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর এবং মৃত্যু ঝুঁকি প্রায় দ্বিগুণ করে তুলতে পারে। তাই একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে ইন্টারনেট-আসক্তি কমিয়ে পরিবারের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানোর দিকে জোর দিয়েছেন মনোবিদরা। তারা বই পড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সৃষ্টিশীল কাজে আরো সময় কাটানোর কথা বলেছেন।
তবে বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা সবচেয়ে দুঃসহ। কাজকর্ম, ব্যস্ততা নেই, নেই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। নানারকম রোগ শরীরে ধরা পড়ে। সন্তানরা বড় হয়ে যার যার মতো আলাদা জগৎ গড়ে তোলে। চেনা পৃথিবীটা হয়ে যায় অচেনা। এ পরিবর্তন অনেকের পক্ষেই মেনে নেয়া কঠিন। আসলে সমাজে বয়স্কদের ব্যাপারে আমাদের উদসীনতা কম নয়। তাদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা আমরা করি না। উল্টো পরিবারের বোঝা মনে করি। বয়স্ক মানুষদের দেখভাল করার দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকেও আমরা প্রায়শ দুরে সরে যাই। বার্ধক্যের একাকিত্ব দূর করতে পুরনো বন্ধুদের খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
একজন নিঃসঙ্গ মানুষের ভালো বন্ধু হতে পারেন আরেকজন নিঃসঙ্গ মানুষ। কেবল পত্রপত্রিকা পড়ে বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে বা ফেসবুকে মুখ গুঁজে না থেকে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ, আশপাশের মানুষের সঙ্গে কুশল বিনিময় পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি করবে।
আমাদের মানবিক সম্পর্কের জমি ক্রমশ রুক্ষ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা–ভরসা–বিশ্বাস-বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নানা প্রতিকূলতা, অপ্রিয় বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে সবাই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ভিড় করছে। কিন্তু এই কোলাহলের জগত প্রতেকটা মানুষকে পরস্পরের কাছে থেকে, আত্মার কাছে থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।
এসডব্লিউএসএস/০৯২০
আপনার মতামত জানানঃ