সমরাস্ত্র-সামরিক শক্তিতে বলীয়ান যুক্তরাষ্ট্রে দিন দিন বাড়ছে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি। ছোট-বড় আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি, প্রযুক্তিনির্ভর নানা হামলার ছক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। অপরাধ পরিস্থিতি হচ্ছে জটিল, এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানির ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই নিরাপত্তা পরিস্থিতি কখনো খুব জটিল হয়ে উঠলে পুলিশ সদস্যদের বদলে সশস্ত্র রোবটকে অভিযানে নামাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো পুলিশ বিভাগ।
শুনে উদ্বেগ জাগলেও এই রোবটকে বলা হচ্ছে ‘কিলার রোবট’ সোজা বাংলায় হত্যাকারী রোবট। এ ঘটনায় অনেক বিশেষজ্ঞই ধারণা করছে, রোবটের হাতে মানুষ খুনের ইতিহাস লেখা হতে চলেছে এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে। যার শেষ হতে পারে ভয়ানক। কারণ মানুষের আচারণগত অনেক কিছুই আছে যা সাধারণ ভাষায় অপরাধ কিন্তু ক্ষমারযোগ্য। এছাড়া মানুষের আচারণকে পরিস্থিতি দিয়ে বিচার করা কি রোবটের পক্ষে সম্ভব? মানুষের জীবনের মূল্য নির্ধারণ কি রোবটের পক্ষে সম্ভব?
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকোতে ক্ষমতাসীন বোর্ড অব সুপারভাইজারস নগরের পুলিশকে হত্যাকারী রোবট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে পুলিশ বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে বিস্ফোরকবাহী রোবট মোতায়েন করতে পারবে। খবর বিবিসির।
স্টপ কিলার রোবটস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ড. ক্যাথেরিন কনোলি বলেন, এটি মানুষকে হত্যা থেকে দূরে রাখার খারাপ উপায়। সান ফ্রান্সিসকোর পুলিশ বিভাগ (এসএফপিডি) বিবিসিকে বলেছে, তারা বর্তমানে প্রাণঘাতী অস্ত্রে সজ্জিত কোনো রোবট পরিচালনা করে না। তবে পুলিশ বলেছে, ভবিষ্যতে রোবটকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যেতে পারে।
পুলিশের একজন মুখপাত্র বলেন, সহিংস, সশস্ত্র ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রোবটগুলোকে বিস্ফোরক দিয়ে সজ্জিত করা হতে পারে। পুলিশ আরও বলেছে, রোবটগুলো সহিংস, সশস্ত্র, বিপজ্জনক ও জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে এমন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাকে অক্ষম করতে পারে।
এ ধরনের রোবট ব্যবহারের পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, শুধু বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেই এই রোবট ব্যবহার করা হবে। তবে বিরোধীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ রোবটের বদলে পুলিশ বাহিনীর আরও সামরিকীকরণ করতে পারে।
তবে গতকাল বুধবার এই ব্যবস্থা অনুমোদনের সময় একটি সংশোধনী জুড়ে দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়েছে, অন্য কোনো উপায় না থাকলেই কেবল পুলিশ কর্মকর্তারা প্রাণঘাতী এসব রোবট ব্যবহার করতে পারবেন। এ ছাড়া উচ্চপদস্থ সীমিত কয়েকজন কর্মকর্তাই এ ধরনের রোবট ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারবেন বলেও বোর্ড জানিয়েছে।
এ ধরনের প্রাণঘাতী রোবট যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য জায়গায় এর মধ্যেই ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ডালাস ও টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে পুলিশ একজন স্নাইপারকে হত্যার জন্য সি-ফোর বিস্ফোরকবাহী রোবট ব্যবহার করে। ওই স্নাইপার আড়াল থেকে দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করেন ও বেশ কয়েকজনকে আহত করেন।
সান ফ্রান্সিসকো পুলিশের একজন মুখপাত্র বলেছেন, কোন পরিস্থিতি কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তা কোনো নীতি দিয়ে অনুমান করা যায় না। তবে পুলিশকে সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
ফেডারেল সরকার স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করতে সামরিক সরঞ্জাম, ছদ্মবেশ, বেয়নেট ও সাঁজোয়া যান সরবরাহ করেছে। তবে এ বছর ক্যালিফোর্নিয়া প্রশাসনের পাস করা আইনে বলা হয়েছে নগর পুলিশকে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে।
স্টপ কিলার রোবটস গ্রুপের কর্মী ড. ক্যাথেরিন কনোলি বলেন, রোবট ব্যবহারের ফলে মানুষ বাহিনীকে ব্যবহার করা কমিয়ে দেবে। প্রথমেই সহজ পন্থা হিসেবে বাহিনী প্রাণঘাতী রোবট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তবে পুলিশের একজন মুখপাত্র বলছেন, ‘সহিংস, সশস্ত্র বা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রোবটগুলোকে সম্ভবত বিস্ফোরক দিয়ে সজ্জিত করা হতে পারে’।
তারা আরও বলছেন, এই ধরনের রোবটগুলো ‘জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টিকারী সহিংস, সশস্ত্র বা বিপজ্জনক সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অক্ষম করতে বা বিভ্রান্ত করতে’ ব্যবহার করা যেতে পারে। এদিকে এই পদক্ষেপের সমর্থনকারীরা বলছেন, হত্যাকারী রোবট শুধুমাত্র চরম পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা হবে। অন্যদিকে বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, কর্তৃপক্ষের এই ধরনের সিদ্ধান্তের বদলে বরং পুলিশ বাহিনীকে আরও সামরিকীকরণ করা যেতে পারে।
সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার একটি সংশোধনীর পর এই পদক্ষেপটি পাস হয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, উত্তেজনা প্রশমনের অন্য কোনও উপায় না থাকলেই কেবল এই ধরনের রোবট ব্যবহার করতে পারবেন কর্মকর্তারা। সান ফ্রান্সিসকোর ক্ষমতাসীন বোর্ড অব সুপারভাইজারস আরও শর্ত দিয়েছে, শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তারা এই রোবটের ব্যবহার অনুমোদন করতে পারেন। অবশ্য এই ধরনের প্রাণঘাতী রোবট ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অংশেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে এই সংবাদে ‘ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হবে পৃথিবী ধ্বংসের কারণ’, স্টিফেন হকিংসের মতো বিজ্ঞানীর এই উক্তি মনে পড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিকই। আতঙ্কিত হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এর মধ্যেই সারা বিশ্বের কারখানাগুলো চলে এসেছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। একেকটি মেশিন কম সময়, খরচ ও নিপুণতার সঙ্গে ১শ-২শ মানুষের কাজ করে দিচ্ছে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ছে বেকারত্ব, সেখান থেকে অভাব-হতাশা-নৈরাজ্য। ধীরে ধীরে মানুষের কাজের জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছে রোবট। এর মধ্যে ঘোর বিপদ দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা।
বিজনেস ম্যাগনেট এলন মাস্ক থেকে উদ্যোক্তা বিল গেটস, সবারই সতর্ক বাণী, সুপারস্মার্ট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করবে বেশি।
সম্পদের চরম অসম বণ্টন, মানবিক বিপর্যয়, আর্টিফিশিয়াল স্টুপিডিটি বা কৃত্রিম নির্বুদ্ধিতাকেন্দ্রিক সমস্যা, প্রোগ্রামিং নির্ভর কৃত্রিম বর্ণবাদ, নিরাপত্তায় ধস, বড় ধরনের যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক বিপর্যয়, মেশিনের অনিচ্ছাকৃত অনিষ্টের মতো ভয়ঙ্কর সব বিপদ দেখা দেবে। যুদ্ধকাজে রোবটের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো এর পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও গবেষণায় ব্যবহার হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এর সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটি নিমেষেই ধ্বংস ডেকে আনবে আমাদের প্রিয় পৃথিবীর।
এসডব্লিউএসএস/১১২৮
আপনার মতামত জানানঃ