গতকাল শনিবার ছিল আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস ২০২২। বিশ্বব্যাপী লিঙ্গভিত্তিক সমতা, বালক ও পুরুষদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা ও পুরুষের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরার প্রধান উপলক্ষ হিসেবে প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর দিবসটি পালন করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে পালন করা হয় দিবসটি। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, কানাডা, ভারত, পাকিস্তান, ক্রোয়েশিয়া, জ্যামাইকা, কিউবা, স্কটল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মাল্টা, কানাডা, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, ইউক্রেন ইত্যাদি
তবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস যতটা আলোচিত, পুরুষ দিবস ততটা নয়। আলোচনা কম হোক বা বেশি, প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর কিন্তু পালিত হয় বিশ্ব পুরুষ দিবস। চলুন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষের অবস্থানটা জেনে নেওয়া যাক। বর্তমানে বাংলাদেশে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন। পুরুষরা পরিবার, সমাজ তথা গোটা বিশ্বে যে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে দিবসটি তারই স্বীকৃতি স্বরূপ। যেসব মহাপুরুষ যুগে যুগে এই মানবসভ্যতা বিনির্মাণে আত্মত্যাগ করে গেছেন, এই দিবস তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
এই দিবস পুরুষ এর কল্যাণার্থে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। পুরুষ দিবসের ৬টি প্রধান প্রতিপাদ্যের মধ্যে অন্যতম ‘নারী ও পুরুষ এর আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়ন এবং নারী ও পুরুষ উভয় এর লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতকরণ।’
পুরুষরা কেন নিগৃহীত হচ্ছেন?
বর্তমানে দাম্পত্য জীবনে ভালোবাসার বন্ধন আগের চেয়ে অনেকটা হালকা। এছাড়া সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন, লোভ-লালসা, উচ্চবিলাসিতা, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব, অবাধ আকাশ সাংস্কৃতিক প্রবাহসহ নানা কারণেই এমনটা ঘটছে।
যার চরম পরিণতি হচ্ছে সংসারের ভাঙন ও নির্যাতন। পারিবারিক অশান্তি ও সংসার ভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারী-পুরুষ উভয়ই। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সমাজের সব অংশই প্রতিনিয়ত ভুগছেন নানা পারিবারিক যন্ত্রণায়। এক্ষেত্রে নির্যাতিত নারীর পাশে সমাজের অনেকেই সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু পুরুষশাসিত এ সমাজে পুরুষও যে নির্যাতিত হতে পারে সেটি যেন কারও ভাবনাতেই নেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আড়ালেই থেকে যায় পুরুষ নির্যাতনের করুণ কাহিনী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্ত্রী কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না পুরুষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, চক্ষুলজ্জা, জেল-পুলিশ আর উল্টো মামলার ভয়ে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
পুরুষ চাইলেও নির্যাতনের কথা বলতে পারছেন না। অন্যদিকে একজন নারী আইনের অপব্যবহার করে ইচ্ছে করলেই ঘটনা সাজিয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে থানা বা আদালতে সহজেই নারী নির্যাতনের মামলা বা যৌতুক মামলা দিতে পারছেন।
জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটির চেয়ারম্যান আইনজীবী সাইদুল হক সাঈদ বলেন, স্ত্রীরা নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক সময় পুরুষও স্ত্রী কর্তৃক শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধে সুনির্দিষ্টভাবে নেই কোনো আইন।
নারী ও শিশু নির্যাতনে ৫টি ট্রাইব্যুনাল তৈরি হলেও পুরুষদের জন্য একটিও নেই। ফলে ভুক্তভোগীদের আইনী সহায়তা দেয়াটা দুরূহ হয়ে পড়ছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সমাজের উচ্চ পদধারী থেকে শুরু করে রিকশাচালক পর্যন্ত অনেক পুরুষই আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য আমাদের কাছে আসছেন।
যৌতুক আইনের অপপ্রয়োগ
পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে যৌতুক আইনের অপপ্রয়োগ সবচেয়ে বেশি। আইনজীবীরা বলেন, যৌতুক আইনের অধিকাংশই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। পারিবারিক যে কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত ঝগড়া হলে সেটি থানা পুলিশে গড়ালে পরিণত হয় যৌতুক মামলায়।
কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলে অথবা স্ত্রীকে তালাক দিলে অথবা উচ্ছৃঙ্খল স্ত্রীকে শাসন করলে অথবা স্ত্রীর পরকীয়ায় বাধা দিলে সেই স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজন থানায় বা আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০-এর ১১(খ) অথবা যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০-এর ৪ ধারায় একটি মামলা করেন। একজন পুরুষের জীবন অতিষ্ট করার জন্য এ একটি মামলাই যথেষ্ট।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের উপকমিশনার বলেন, শুধু নারীই নন পুরুষও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেক পুরুষ খারাপ মেয়েদের ট্র্যাপে পড়ে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করছে। শুধু নারীই নন, পুরুষও নারীর দ্বারা ভিকটিমাইজ হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা পেশাগত দায়িত্বের বাইরে অনেক কিছু গোপন রেখে
কাউন্সিলিং ও আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকি।আর পারিবারিক মামলার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনের সঙ্গে যৌতুকের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু দাম্পত্য কলহ হলেই যৌতুকের মামলা দেয়া হয়। এতে পরিবারের সন্তানরাও কিন্তু দিশেহারা হয়ে যায়।
পারিবারিক মামলা শুধু পুলিশ দিয়ে ঠেকানো যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুরুষ নির্যাতনের সংখ্যা নারীর তুলনায় অনেক কম। পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ভুল বোঝাবুঝি হলে নিজেদের মধ্যে সমাধান করতে হবে। নির্যাতন বন্ধ হতে হবে ঘর থেকেই।
দেনমোহর কেলেঙ্কারি
আমাদের দেশে সাধারণত বিয়ের সময় পাত্রী পক্ষ জোরপূর্বক পাত্রকে সাধ্যের অতিরিক্ত টাকা কাবিন নামায় ধার্য করতে বাধ্য করেন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কাবিন হয় বাকিতে। অর্থাৎ দেখা গেল কনে পক্ষের দাবি অনুযায়ী, কাবিন করা হল ১০ লাখ। এর মধ্যে গহনা ও অন্যান্য জিনিস বাবদ ২-৩ লাখ টাকা পরিশোধ দেখিয়ে পুরোটাই বাকি রাখা হয়।
যদিও ইসলামী বিধান হলো বিয়ের সময়ই দেনমোহর পুরোটা পরিশোধ করা। তবে এই কথা শোনে কে? বাকি থাকা বা বাড়তি এই দেনমোহরই পরে কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন কেস স্টাডি থেকে জানা গেছে, অতিরিক্ত দেনমোহরের কারণে স্বামী তার স্ত্রী ও তার পরিবারের লোকজনের অনৈতিক দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলছেন, পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন, তবে কতটা হচ্ছেন তা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি বা গ্রহণযোগ্য তথ্য উপাত্ত এখনো নেই।
“তবে মনে রাখতে হবে আমাদের সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। এখানে কিন্তু ব্যক্তি পুরুষের কথা বলা হচ্ছেনা। অনেক পুরুষই সমতার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তবে সমাজে কিছু প্রচলিত ধারণা আছে যেমন পুরুষের কান্না করা মানায়না বা বিয়ের সময় বলা হয় ছেলে কি করে আর মেয়ে দেখতে কেমন। এগুলো পুরুষতান্ত্রিকতারই ফল।”
সালমা আক্তার বলেন, “পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হলে সেটিও মানবাধিকার ইস্যু। তবে দেখতে হবে কি কারণে হচ্ছেন। তিনি কি পুরুষ দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন নাকি নারীর দ্বারা। শুধু নারী হওয়ার কারণে অনেক নারী যেমন সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। তেমনি পুরুষ যদি পুরুষ হওয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হন তাহলে এটাও জেন্ডার ইস্যু।”
তিনি বলেন, একই সাথে দেখতে হবে পুরুষ নির্যাতনের শিকার হলে সেটি কি কারণে হচ্ছেন। সেটি কি অর্থনৈতিক নাকি অন্য কোনো কারণে। কারণ ও ধরণ বের করে সেভাবেই সেটিকে বিবেচনা করতে হবে।
“তবে সমাজে পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টিকে পুরোপুরি ফেলে দেয়া যাবেনা। এর অস্তিত্ব স্বীকার করেই দেখতে হবে কতটা ব্যাপক ও এর কারণ ও ধরণ কি। তাহলেই বোঝা যাবে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কারণ কোনো ধরনের সহিংসতাকেই এড়িয়ে যাওয়া ঠিক নয়।”
রংপুরে ‘বাংলাদেশ মেন’স রাইটস ফাউন্ডেশন’ এর আইনি পরামর্শক রিজওয়ানা আখতার শিরিন জানান, তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন পুরুষকে পেয়েছেন যাদের নির্যাতিত বলেই তার কাছে মনে হয়েছে।
“এমন অনেক ঘটনা পাচ্ছি যেখানে পুরুষরা নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্তু লজ্জায় বা ভয়ে বলতে পারছেন না। লোক হাসাহাসির ভয়ও কাজ করে তাদের মধ্যে। সম্প্রতি একটি ঘটনা পেয়েছি যেখানে স্ত্রী পরকিয়া করতে গিয়ে স্বামীর টাকা পয়সা নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে উল্টো নির্যাতন ও দেনমোহরের মামলা করেছেন। এমন নানা ধরণের ঘটনা আমরা এখন পাচ্ছি। এসব কারণেই আইনি সুরক্ষার দাবি জোরালো হচ্ছে যাতে পুরুষ অকারণে ভিকটিম না হন।”
এসডব্লিউএসএস১২০০
আপনার মতামত জানানঃ