নরসিংদীর রায়পুরা থানা-পুলিশের হেফাজতে সুজন মিয়া (৩৫) নামে রিমান্ডে থাকা এক আসামির মৃত্যু হয়েছে। নিহত সুজন মিয়া রায়পুরা উপজেলার মাহমুদপুর এলাকার মুজিবর রহমানের ছেলে এবং নিজ স্ত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা মামলার আসামি। পুলিশের দাবি বিষয়টি আত্মহত্যা।
গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত থেকে আজ বুধবার সকাল ১০টার মধ্যে কোনো এক সময়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়।
পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার (৫ নভেম্বর) মধ্যরাতে স্ত্রী লাভলী বেগমের সঙ্গে ঝগড়ার একপর্যায়ে সুজন মিয়া ধারালো ছুরি দিয়ে স্ত্রী লাভলীকে পেটে আঘাত করে হত্যা করে পালিয়ে যায়। এঘটনায় নিহতের মা মালেকা বেগম নিজে বাদী হয়ে রায়পুরা থানায় মামলা করলে গত সোমবার বিকেলে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার আটরশি দরবার শরীফের পাশ থেকে নরসিংদী জেলা পুলিশের একটি টিম আসামি সুজন মিয়াকে গ্রেপ্তার করে।
পরে পুলিশে জিজ্ঞাসাবাদে সে প্রাথমিকভাবে স্ত্রী হত্যার অপরাধের বিষয়ে স্বীকার করে। পরদিন মঙ্গলবার বিকেলে পুলিশ বিজ্ঞ আদালতে তুলে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রাতে রিমান্ডের উদ্দেশ্যে রায়পুরা থানা হাজতে ঢোকানো হয় এবং সকালে থানা থেকে তাঁর মরদেহ রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় পুলিশ। জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার খান নূরউদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর জানান, সকাল সাড়ে দশটায় হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা-নীরিক্ষা শেষে মৃত ঘোষণা করেন। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে গলায় মোটা দাগ রয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আল আমিন জানান, আজ সকাল ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে রায়পুরা থানা হাজতের ওয়াশ রুমের ভেতরে জানালার রডের সঙ্গে নিজের পরিহিত শার্ট দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। পরবর্তীতে তাকে দ্রুত রায়পুরা থানা-পুলিশ উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কীভাবে ঘটনা ঘটছে তা ময়নাতদন্তের পর জানা যাবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মৃতদেহের সুরতহাল করা হচ্ছে। রায়পুরা থানা-পুলিশ কর্তৃক আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। উল্লেখিত বিষয় বিস্তারিত অনুসন্ধানের জন্য জেলা পুলিশ নরসিংদী কর্তৃক ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। বিচার চেয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগী পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করার পর পরিবারকে দেয়া হচ্ছে হুমকি। এ কারণে পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিচার প্রত্যাশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পুলিশী নির্যাতনে আহত হলেও ভুক্তভোগীরা মামলা করেন না। তবে এসব ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে বলে পুলিশ সদর দফতর জানিয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের চাকরিচ্যুত, পদোন্নতি স্থগিত ও পদাবনতির মতো শাস্তি দেয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর ও মানবাধিকার সংগঠন সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে অন্তত ১১টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পুলিশ হেফাজতে। ২০২১ সালে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ২৯ জনের। গত ৫ বছরে অন্তত ১৫৮ জনের পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় একজনের শাস্তি হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় ১৪ মামলা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় শাস্তি থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর ক্রসফায়ার কমে গেলেও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা চলছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যে দাবি করা হয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে পুলিশ হেফাজাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১১টি। গত বছর ২০২১ সালে পুলিশ হেফাজতে ২৯টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০২০ সালে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ২৪টি, ২০১৯ সালে ১৬টি। ২০১৮ সালে ৫৪টি ও ২০১৭ সালে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি। ২০১৩ সালে মৃত্যু নিবারণ আইন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র ১৯টি। একটি মামলায় আসামিদের শাস্তি হয়েছে। ১৪টি মামলায় মামলা ত্রæটিপূর্ণ বলে চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে ক্রসফায়ার কমলেও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে, এমনটাই মানবাধিকার সংগঠন আসকের দাবি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০১৯ সালেই সারাদেশে পুলিশের হেফাজতে ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে গ্রেফতারের আগে নির্যাতনে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। গ্রেফতারের পর শারীরিক নির্যাতনে ছয় জনের মৃত্যু হয়েছে। থানার হাজতখানায় দুই জন আত্মহত্যা করেন। দুই জন অসুস্থ হয়ে মারা যান। বাকি দুই জন নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসাধীন মারা গেছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২৭
আপনার মতামত জানানঃ