খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৫৫০ অব্দের দিকে সাইরাস দ্য গ্রেটের হাত ধরে গোড়াপত্তন ঘটে আকেমেনিড সাম্রাজ্যের। আকেমেনিড সাম্রাজ্যের পাশাপাশি ইতিহাসে এটি ‘প্রথম পারস্য সাম্রাজ্য’ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো, ইতিহাসের বর্ণিল পাতায় ঠাঁই নেওয়া প্রাচীন পারস্য সভ্যতার অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগই বর্তমান ইরানের অন্তর্ভুক্ত। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এই সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে উন্নতি শিখরে পৌঁছেছিল, এর দিকে একটু নজর দিলে যারপরনাই অবাক হতে হয়।
বর্তমান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল-বিজ্ঞানে নানাবিধ জিনিসের উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন পারস্যের সব্যসাচী রূপকারদের হাত ধরে। তাই, বিজ্ঞান নানা ক্ষেত্রে এই সভ্যতার নিকট বহুলাংশে ঋণী।
সমকালীন অন্যান্য সভ্যতা থেকে তারা জ্ঞান, বিজ্ঞান, গণিত, বা জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় যোজন যোজন এগিয়ে ছিল। প্রাচীন পারস্য সভ্যতার এমন যুগান্তকারী দুই আবিষ্কার নিয়েই এই আয়োজন।
একটি হলো ইয়াখছাল (রেফ্রিজারেটর)। ইয়াখছাল হলো প্রাচীন এক শীতলীকরণ পদ্ধতি (স্থাপনা), যেখানে বাষ্পীভবন পদ্ধতি অনুসরণ করা হতো। ‘ইয়াখ’ শব্দের অর্থ হলো ‘বরফ বা ঠাণ্ডা’, ‘ছাল’ শব্দের অর্থ হলো ‘কূপ’। একে বর্তমানের বরফঘরের সাথে তুলনা দেওয়া যেতে পারে।
ইয়াখছাল মূলত বরফঘরের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই তৈরি করা হতো। প্রাচীন পারস্যে এই হিমায়ক কক্ষ তৈরি করা হতো খ্রি.পূ. ৪০০ অব্দের দিকে। এই স্থাপত্যের উপরিভাগ ছিল গম্বুজাকৃতির, এবং এর ভেতরের দিকে ছিল কতক ফাঁপা জায়গা।
নিরেট, তাপরোধী কিছু গাঠনিক উপাদান দিয়ে ভেতরের দিকের ফাঁপা জায়গা মুড়িয়ে দেওয়া হতো। অন্তভৌমের ফাঁপা জায়গার আয়তন হতো প্রায় ৫,০০০ ঘন মিটারের মতো। হাজার বছর আগের প্রাচীন এই স্থাপনাগুলো এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কাঠামোটিতে শীতল বাতাস প্রবেশ করত এর ভিত্তি এবং অন্তভৌমের ফাঁপা অংশ দিয়ে। এর মোচাকৃতির গঠন দিয়ে গরম তাপ বেরিয়ে যেত। ফলে, ভেতরের অংশের তাপমাত্রা হতো বাইরের অংশ থেকে কম। এগুলো তৈরি করা হতো সারোজ নামে পানি-রোধী হামানদিস্তা দিয়ে।
বালি, কাদা, ডিম, ছাগলের পশম এবং ছাই সঠিক অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি করা হতো সেই বিশেষ হামানদিস্তা। এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, এটি তাপ ও পানিরোধের উপযোগী। স্থাপনার ভিত্তির দিকে দেওয়ালের পুরুত্ব ছিল কমপক্ষে ২ মিটার। এর আসল কাজ ছিল বরফ সংরক্ষণ করে রাখা।
বরফের পাশাপাশি একে আজকের দিনের মতো খাবার সংরক্ষণেও ব্যবহার করা হতো। শীতকালে জমাট বাধা বরফকে ইয়াখছালে সংরক্ষণ করে রাখা হতো গরমকালে ব্যবহারের জন্য।
অন্য আবিষ্কারটি হলো ব্যাটারি। ১৯৩৮ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের অদূরে খুজুত রাবু নামক স্থানে জার্মান পুরাতাত্ত্বিক উইলহেম কনিগ সন্ধান পান ৫ সে.মি. লম্বা বিস্ময়কর এক পাত্রের। পাত্রটি ছিল সিরামিক নির্মিত। এর ভেতরে একটি ধাতব নল এবং ভিন্ন ধাতুর তৈরি এক লৌহদণ্ডের অস্তিত্ব মেলে।
ইতিহাসে তা জায়গা করে নেয় ‘বাগদাদ ব্যাটারি’ নামে। লোহার দণ্ডটি ছিল তামা দিয়ে আবৃত। ধারণানুযায়ী, তামার নলের ভেতর অম্লীয় দ্রবণ ব্যবহার করে ব্যাটারিটি সচল করা হতো। কনিগের মতে, প্রাচীন পারস্যে এমন ব্যাটারি তৈরি করা হতো খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ অব্দের দিকে।
সন্দেহের পালে আরও জোর হাওয়া লাগিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী উইলার্ড গ্রে। তিনি ঝটপট বাগদাদ ব্যাটারির একটি রেপ্লিকা তৈরি করে ফেলেন। এতে ভিনেগার ঢেলে সফলতার মুখ দেখেন গ্রে। তখন ব্যাটারিটি সচল হয়ে প্রায় ১.৫ থেকে ২.০ ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়।
১৯৩০ সালে উইলহেম কনিগ একটি পেপারে উল্লেখ করেন, প্রাচীন পারস্যে বাগদাদ ব্যাটারিকে হয়তো গ্যালভানিক কোষ হিসেবে ব্যবহার করে ইলেক্ট্রোপ্লেটিং করা হতো। কিন্তু এই হাইপোথিসিসকে নাকচ করে দেন বিজ্ঞানীরা।
অনেকে সরাসরি দ্বিমতও পোষণ করে এই মতবাদে। ফলে, বাগদাদ ব্যাটারি মূল রহস্য থেকে যায় ধোঁয়াশায় আড়ালে। পারস্যে এটি ব্যাটারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকলে বদলে যাবে চিরাচরিত ইতিহাস। তখন বলতে হবে, আলেসান্দ্রো ভোল্টার প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বেই নির্মিত হয়েছিল বিশ্বের প্রথম ব্যাটারি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ