শেষ মায়ান শহরের জায়গায় প্রত্নবস্তু উন্মোচন করেছে গুয়াতেমালার প্রত্নতাত্ত্বিকরা। প্রত্নবস্তুর মধ্যে রয়েছে, সিরামিক, মানুষের সমাধিক্ষেত্র এবং স্প্যানিশ বন্দুকের বুলেট। সম্প্রতি এ কথা জানিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এএফপির বরাত দিয়ে এ খবর জানিয়েছে পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডন।
খননের দায়িত্বে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন, নতুন খনন প্রকল্পটি গত জুনে টায়াসাল ফাঁড়ি সম্পর্কে আরও বোঝার প্রয়াসে শুরু হয়েছিল। যেখানে মায়ান বাসিন্দারা তাদের প্রাক-ক্লাসিক যুগে ৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল।
সুয়ারলিন কর্ডোভা বলেন, ইউরোপীয়রা গুয়াতেমালার পশ্চিম উচ্চভূমিতে প্রবেশের এক শতাব্দী পরে ১৬৯৭ সালে স্প্যানিশ বিজয়ের কাছে হারানো শেষ মায়ান শহর ছিল টায়াসাল।
“১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে গুয়াতেমালার উত্তর অংশ সম্পূর্ণরূপে স্প্যানিশ শাসনের বাইরে ছিল। এর প্রধানত কারণ ছিল, জঙ্গল প্রাকৃতিক সীমানা হিসাবে কাজ করেছিল, যা এই জায়গায় স্প্যানিয়ার্ডদের আগমনকে খুব কঠিন করে তুলেছিল।”
১৫২৫ সালে স্প্যানিশ বিজয়ী হার্নান কর্টেস তার বর্তমান হন্ডুরাসের যাত্রায় ব্যবহৃত রুটেরও অংশ ছিল টায়াসাল। টায়াসাল সাইটের বেশিরভাগ বিল্ডিং পেটেন ইতজা হ্রদের কাছে সাত-বর্গ-কিলোমিটার এলাকায় মাটি এবং গাছপালা নীচে চাপা পড়ে আছে।
সাইটে আংশিকভাবে উন্মুক্ত কাঠামোর মধ্যে একটি ৩০-মিটার-উচ্চ অ্যাক্রোপলিস রয়েছে, যা গবেষণা অনুসারে শাসক অভিজাতদের বাসস্থান হিসাবে কাজ করে। প্রাক-হিস্পানিক সময় থেকে ব্যবহৃত একটি জলের কূপও দেখা গেছে।
গুয়াতেমালার সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রী জেনি ব্যারিওস বলেছেন, প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হল সাইটটিকে উন্নত করা। যাতে পর্যটকরা বিশাল অঞ্চলের মায়ান প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যকে আরও ভালভাবে “প্রশংসা” করতে পারে।
মায়া সভ্যতা ২৫০ এবং ৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বর্তমান দক্ষিণ মেক্সিকো এবং গুয়াতেমালা, পাশাপাশি বেলিজ, এল সালভাদর এবং হন্ডুরাসের কিছু অংশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
সাইটে আংশিকভাবে উন্মুক্ত কাঠামোর মধ্যে একটি ৩০-মিটার-উচ্চ অ্যাক্রোপলিস রয়েছে, যা গবেষণা অনুসারে শাসক অভিজাতদের বাসস্থান হিসাবে কাজ করে। প্রাক-হিস্পানিক সময় থেকে ব্যবহৃত একটি জলের কূপও দেখা গেছে।
আমাজনের ২ মিলিয়ন বর্গমাইল আয়তনের বিশাল জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতা, পৃথিবীর ইতিহাসে যা মায়া সভ্যতা নামে পরিচিত। হাজার হাজার বছর পুরনো এ সভ্যতাকে আমেরিকাতে স্প্যানিশদের আসার আগে সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতা হিসেবে ধরা হয়। তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত সভ্যতা ছিল এ মায়া সভ্যতা। মায়া সভ্যতায় বসবাসকারীদের মায়ানও বলা হতো।
২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য আমেরিকার বর্তমান বেলিজে মায়া সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া যায়। বর্তমান মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভেদরের ১০০০ কিলোমিটার জুড়ে ছিল মায়া সভ্যতা। এর বাইরেও অনেক জায়গায় শিল্প ও সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রি-ক্লাসিক্যাল পিরিয়ডে, যা ২৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল, মায়া সভ্যতার ধীরে ধীরে প্রসারণ ঘটতে থাকে। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারা কৃষি কাজ এবং বসতি স্থাপন শুরু করে। তার পূর্বে তারা শিকার করে ও ফলমূল জোগাড় করে জীবনধারণ করত। এরপর ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে সেকোনুস্ক অঞ্চলে তারা বসতি স্থাপন করে।
এরপর তারা ধীরে ধীরে পুরো মেসোআমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে ও বিশাল বিশাল স্থাপত্য কার্যের শুরু করে। এসব অঞ্চলজুড়ে তাদের শিলালিপি, মৃৎশিল্প ও স্থাপত্য কলার বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায়।
২৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ ছিল মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ। এ সময় এ অঞ্চলে ৪০টিরও বেশি শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করে যার কিছু কিছুর জনসংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি ছিল। এই সময়ে বড়-ধরনের নির্মাণকার্য, শিল্পকর্মের উন্নয়ন ও কৃষির অভাবনীয় বিকাশ সাধন হয়েছিল। তারা পাথরের বিশাল অবকাঠামো দিয়ে শহর নির্মাণ করেছিল। প্রত্যেক মায়া নগররাষ্ট্রে একটা করে স্থানীয় রাজা বা আহাও থাকতেন। তিনি বসবাস করতেন রাজপ্রাসাদে। তার সঙ্গে বিশাল রাজপরিবারও ওই রাজপ্রাসাদে থাকত।
প্রত্যেক রাজপ্রাসাদের উত্তর প্রান্তে থাকত একটা বাণিজ্য কুঠি, বড় রাস্তা এবং দক্ষিণ প্রান্তে থাকত পিরামিড এবং কৃষিজমি। মায়া সভ্যতায় বিভিন্ন রাজ্যের মাঝে সংঘাতের ঘটনাও দেখা যায়। আর এ বিষয়টি দেখা গেছে হলমুলের ক্ষেত্রে। হলমুল শহরটি তেমন বড় কিংবা বিখ্যাত নয় টিকালের মতো। ২০০০ সাল পর্যন্ত এ শহরটি সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানলেও সেভাবে গুরুত্ব দেননি।
মায়া সভ্যতা বিখ্যাত হয়ে আছে তাদের স্থাপত্যশিল্প, বিশাল বিশাল ঘরবাড়ি, পিরামিড আর মূর্তিগুলোর জন্য। এখনও মায়া সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের তৈরি পিরামিড, ঘরবাড়ি, প্রাসাদ আর অট্টালিকা।
তারা এসব ঘরবাড়ি বানাত লাইমস্টোন নামের এক ধরনের পাথর দিয়ে। এই পাথরকে বাংলায় বলা হয় চুনাপাথর। আর সেই পাথরগুলোকে সুন্দর মসৃণ করতে ব্যবহার করতো সিমেন্টের মতো একধরনের পদার্থ। আর সেগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হাজার হাজার শ্রমিক দিনের পর দিন পরিশ্রম করত। তবেই না তৈরি হতো বিশাল বিশাল আর সুন্দর সুন্দর সব ঘরবাড়ি-পিরামিড-প্রাসাদ-অট্টালিকা।
মায়ানদের শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণের পদ্ধতি ও ভাষাও ছিল অদ্ভুত। তারা একটার পর আরেকটা বর্ণ লিখত না। এমনকি লেখার জন্য তারা কোনো বর্ণই ব্যবহার করত না; লিখত ছবি বা লোগো দিয়ে। শুধু তাই না, মায়ানরা সেই সময়েই গণিতে ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বেশ অবদান রেখেছিল। খালি চোখেই গ্রহ নক্ষত্রদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে হিসেব করে তাদের গতি-প্রকৃতি তারাই প্রথম নির্ণয় করেছিল। তারা সূর্য ও আকাশের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি নির্ভুল বর্ষপঞ্জিকা বানাতে পেরেছিল যা তাদের কৃষিতে সহায়তা করত। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম মায়ারাই ১ বছরে ৩৬৫ দিন আছে তা আবিষ্কার করতে পেরেছিল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫১
আপনার মতামত জানানঃ