দীর্ঘ ৪ হাজার বছর আগে, যখনও পৃথিবীর অন্যান্য জাতি সবেমাত্র আগুন জ্বালিয়ে কাঁচা মাংস সেদ্ধ করে খেতে শিখেছিল, মায়ানরা তখন একের পর এক বানিয়ে চলেছিল পাথরের তৈরি সুউচ্চ সব স্থাপনা। জ্যোতির্বিদ্যা, ক্যালেন্ডার তৈরি থেকে শুরু করে খানিকটা সাহিত্যচর্চাও করত তারা। কেমন করে তারা এই উন্নতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল, তা এক রহস্যই বটে!
প্রাচীন সভ্যতা মানেই রহস্য; পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর একটি মায়া সভ্যতা। এটি শুধু প্রাচীনই নয় বরং সভ্যতার মধ্যে সব থেকে বেশি রহস্যে ঘেরা। আমাজনের ২ মিলিয়ন বর্গমাইল আয়তনের বিশাল জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে এই রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতা; পৃথিবীর ইতিহাসে যা মায়া সভ্যতা নামে পরিচিত। হাজার হাজার বছর পুরনো এ সভ্যতাকে আমেরিকাতে স্প্যানিশদের আসার আগে সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতা হিসেবে ধরা হয়। তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত সভ্যতা ছিল এ মায়া সভ্যতা। মায়া সভ্যতায় বসবাসকারীদের মায়ানও বলা হতো।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে অদ্ভুত কিছু পান্ডুলিপি আর ফলক আবিষ্কৃত হয়। নৃতত্ত্ববিদদের গবেষণা মতে এগুলি প্রাচীন মায়া সভ্যতার নিদর্শন। মায়া শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে ‘মায়াপান’ এর প্রাচীন শহর ইউকাতান থেকে। ইউকাতান ছিল পোস্ট-ক্লাসিক সময়ে (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-২৫০ খ্রিস্টাব্দ) মায়ান সাম্রাজ্যের শেষ রাজধানী। মায়াদের সম্পর্কে জনপ্রিয় একটি ভুল ধারণা আছে যে, তারা হারানো জাতি। মায়ারা হারিয়ে যায়নি, বরং তাদের বংশধরেরা চিচেন ইত্জা, বোনামপাক, উক্সমাল এবং আলতুন হা নামের বিখ্যাত যে শহরগুলো স্থাপন করেছিল, সেগুলো এখনো সেই একই স্থানে বিদ্যমান এবং একহাজার বছর আগে যে রীতি-নীতির চল ছিল, সেগুলোর পরিবর্তিত রূপ এখনো সেখানকার স্থানীয়রা অনুশীলন করে থাকে।
মেসোআমেরিকান ইন্ডিয়ানস বা মায়া জনগণ মূলত বসবাস করতো বিশাল এলাকা জুড়ে যার মধ্যে ছিল দক্ষিণ পূর্ব মেক্সিকো এবং উত্তরের কেন্দ্রীয় আমেরিকা। মায়া সভ্যতার লোকেদের তৈরি করা পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায় যে, তারা ভাবের আদান-প্রদান করার জন্যে একটি ভাষার ব্যবহার করত। অদ্ভুত এবং মজাদার ছিল মায়াদের সেই ভাষার লিখিত রূপটি। তাদের কোনো বর্ণমালা ছিল না, তারা লেখার জন্যে ছবি বা চিহ্ন ব্যবহার করত। খানিকটা হায়ারোগ্লিফিক লেখা। তাদের লেখায় প্রায় ৮০০টির বেশি ছবি তারা ব্যবহার করেছিল। মায়ানদের এইসব লেখা থেকে তাদের সভ্যতা আর সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। অবাক করা বিষয় হল মায়ারা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি করা কাগজ দিয়ে বই বানাতো, সেগুলোকে বলা হয় কোডেক্স। মায়ান সভ্যতার মাত্র ৪টি কোডেক্স উদ্ধার করা হয়েছে অক্ষতভাবে।
মায়া সভ্যতার ইতিহাস মূলত তিনটি প্রধান যুগে বিভক্ত; প্রি-ক্লাসিক, ক্লাসিক এবং পোস্ট-ক্লাসিক যুগ। আর এই তিনটি যুগের শুরুতে ছিল আর্কাইক যুগ, যখন মায়ান জনগোষ্ঠী প্রথম বসতি স্থাপন করে এবং কৃষিক্ষেত্রে প্রাথমিক উন্নয়ন ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০-২০০০ সময়কালকে আর্কাইক যুগ বলা হয়। এই যুগে একটি শিকারি-সংগ্রাহক কৃষ্টি অনুশীলন করা দল ভুট্টা, বীন এবং অন্যান্য সবজির চাষ শুরু করে, এবং পশু-পাখি পালন শুরু করে; বিশেষত কুকুর এবং টার্কি। এই যুগে প্রথম যে বসতিগুলো স্থাপিত হয়েছিল, সেখানে বিভিন্ন দেব-দেবীদের জন্য বিশেষ স্থান এবং মন্দির নির্দিষ্ট করা ছিল। এই বসতিগুলোর প্রসার ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালের সময়।
ওলমেক যুগ বা প্রি-ক্লাসিক যুগের সূচনা ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে। এ যুগেই মেসোআমেরিকার সর্বপ্রাচীন ওলমেক সংস্কৃতির উদয় ঘটে। মেক্সিকো উপসাগর ঘেঁষা এলাকায় তারা বসতি স্থাপন করে এবং ইট-পাথরের বড় বড় শহর তৈরি করে। সেই শহরগুলোর ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাপ্ত বিখ্যাত ওলমেক মূর্তিগুলোর মাথা থেকে ভাস্কর্য শিল্পে তাদের বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। একই সাথে এই মূর্তিগুলো থেকেই সেই যুগে শামানিক ধর্মের চর্চার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়।
ওলমেক ধ্বংসস্তূপের বিশালতার জন্য এই ধারণা জন্ম নেয় যে, ওলমেক ছিল দানবদের আবাসস্থল। ওলমেকরা কোথা থেকে এসেছে বা পরবর্তীতে তাদের কি হয়েছিল, সে বিষয়ে কারো কিছু জানা না থাকলেও এই বিষয়টি নিশ্চিত যে, তারাই মেসোআমেরিকাতে ভবিষ্যৎ সভ্যতার বীজ বপন করেছিল। প্রি-ক্লাসিক যুগের সমাপ্তি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ শতাব্দীতে।
মায়া সভ্যতার ক্লাসিক যুগ সেই সময়টাকে ধরা হয় যখন নিম্ন ভূমির মায়ারা লং কোর্ট ক্যালেন্ডার ব্যবহার করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা শুরু করে। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ থেকে শুরু করে ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই যুগে ইউকাতেক মায়ার চিচেন, ইতজা এবং উক্সমাল এর মত শক্তিশালী শহরগুলোর শক্তি একত্রিত হয়। এই যুগেই মায়া সভ্যতার বড় আকারের নির্মাণ এবং নগরায়ন ঘটে, স্মারক শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ করণ এবং বিশেষত দক্ষিণের নিম্নাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক বিকাশ ঘটে।
ক্লাসিক যুগে মায়ান রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে রেনেসাঁ বা ক্লাসিক্যাল গ্রীসের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের তুলনা করা হয় মায়ানদের একাধিক নগর-রাজ্য এক জটিল শত্রুতা-মিত্রতায় জড়িত ছিল। সেই যুগের সবচেয়ে বড় শহরগুলোয় জনসংখ্যা ছিল ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত। ক্লাসিক যুগ হচ্ছে সেই সময় যখন মায়া সভ্যতা তাদের গাণিতিক বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা এবং শিল্পের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে এবং নিখুঁত ভাবে মায়ান ক্যালেন্ডার সংস্কার করে।
ক্লাসিক যুগের প্রথম দিকে সমগ্র মায়া অঞ্চল জুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল মেক্সিকো উপত্যকার শক্তিশালী শহর তিউতিহুয়াকান। ৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিউতিহুয়াকান তিকাল এবং অন্যান্য নিকটবর্তী শহরের উপর হস্তক্ষেপ করে, যার ফলে শহরের শাসকরা পদত্যাগ করে এবং শহরে নতুন তিউতিহুয়াকান-সমর্থিত রাজশাসন শুরু হয়। আর নতুন রাজশাসন চালু হওয়ার পর তিলান হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় নিম্নভূমির সবচেয়ে শক্তিশালী শহর আর রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। তিকালের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পেটেন বেসিনের আরেকটি শক্তিশালী শহর চালাক্মুল।
মায়া সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে ক্লাসিক যুগে। কোন কিছুর জন্ম বা মৃত্যু নেই; মায়াদের এই বিশ্বাস থেকে ঈশ্বর এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে তাদের ধারণা জন্মে। তাদের মহাকাশ সম্পর্কিত জ্ঞান প্রভাব ফেলে তাদের স্থাপনা, গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার উপর। তারা বিশ্বাস করতো, পৃথিবীর নিচে শিবাল্বা বা ‘আতংকের স্থান’ আছে যেখানে আছে জীবনের গাছ। সেই গাছ পাতাল থেকে স্বর্গ পর্যন্ত প্রসারী এবং তামোয়ানচান এর স্বর্গে পোঁছাতে পাড়ি দিতে হবে ১৩ টি ধাপ। মায়ানদের বিশ্বাস, কেউ মরে গিয়ে স্বর্গ বা নরকে যায় না, বরং তামোয়ানচান এর পথে যাত্রা করে আর এই যাত্রার শুরু হয় অন্ধকার শিবাল্বা থেকে যেখানে সবকিছু বিভ্রান্তিকর এবং ধ্বংসাত্মক।
মায়ান শিল্প মূলত বিবেচ্য ছিল রাজ শিল্প হিসেবে। মায়ান শিল্পের মূল বিষয়বস্তুও ছিল উচ্চ বর্গের মায়ান এবং তাদের জীবনযাপন। মায়া শিল্প তৈরি হত ক্ষয়িষ্ণু এবং অক্ষয় ধাতু দিয়ে যা মায়াদের সাথে তাদের পূর্বপুরুষদের সংযোগের চিহ্ন হিসেবে হাজির করা হত। এলাকা ভেদে মায়াদের শিল্পের ধরন এবং লেখনীর ধরন ভিন্ন হত।
মায়ান সভ্যতার পিরামিডগুলো দেবতাদের পাহাড় উইটজবের আদলে বিশালাকারে নির্মিত। ভাস্কর্য তৈরির ক্ষেত্রেও মায়ানদের জুড়ি মেলা ভার। অপূর্ব সুন্দর, নিখুঁত কারুকার্যে পরিপূর্ণ ভাস্কর্য থেকে ধারণা করা যায় যে, অনেক আগে থেকেই মায়ান সভ্যতায় ভাস্কর্য চর্চার শুরু হয়। এমন অনেক কাঠের তৈরি ভাস্কর্য এবং হায়ারোগ্লিফিক প্যানেল আছে যা যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। ম্যুরাল চিত্রের সাথেও মায়ান সভ্যতার সম্পর্ক অনেক পুরনো। সান বারতোলোতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ এবং ২০০ সালে নির্মিত বেশ কিছু ম্যুরাল চিত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।
মায়ানদের চিকিৎসাবিদ্যা অনেক আধুনিক ছিল। তারা শরীরের ক্ষত মানুষের চুল দিয়েই সেলাই করে ফেলত। দাঁতের গর্ত পূরণ করা, এমনকি নকল পা লাগানোতেও পারদর্শী ছিলেন তারা। ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ‘পোকা’ ধরা দাঁতে চুন বা ধাতব ফিলিং করতে পারদর্শী ছিলেন প্রাচীন মায়া সভ্যতার চিকিৎসকরা। মায়ানরা প্রকৃতি থেকে ব্যথানাশক জরি-বুটি সংগ্রহ করত। সেই সব গাছ-গাছড়া তারা পূজায় ব্যবহার করত ধর্মীয় রীতি অনুসারে, আবার ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করত রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য, কিংবা সুস্থ করার জন্য।
প্রি-কলোম্বিয়ান মেসোআমেরিকাতে এবং গুয়েতেমালা, ভেরাক্রুজ, অয়াক্সাকা ও মেক্সিকোর চিয়াপাসে এখনও মায়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। মায়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহারে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তার চল কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছিল। মায়ান ক্যালেন্ডার দুই ধরনের হয়ে থাকে; দ্য হাব বা সাধারণ ক্যালেন্ডার (৩৬৫ দিন, ১৮ মাস, মাসে ২০ দিন) এবং যোল্কিন বা পবিত্র ক্যালেন্ডার (২৬০ দিন, মাসগুলো ৩ টি ভাগে বিভক্ত, মাসে ২০ দিন)। হাব এবং যোল্কিন ক্যালেন্ডার একসাথে কাজ করে একই মেশিনের দুইটি অংশের মত। মায়ান ক্যালেন্ডারের মাসগুলোর দায়িত্ব ছিল আলাদা আলাদা দেবতাদের উপর। যেহেতু দেবতারা অমর, সেহেতু দেবতাদের কাজ ছিল তাদের নির্দিষ্ট মাসগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে শক্তির সঞ্চার করা।
এক বছর সমান ৩৬৫ দিন জানা থাকলেও, আসলে এক বছর মানে ৩৬৫ দিন নয়। প্রকৃত হিসাবটা হচ্ছে এক বছর সমান ৩৬৫.২৪২২ দিন। আর জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এক বছর সমান ৩৬৫.২৪২৫ দিন। কিন্তু মায়ানদের হিসাব অনুযায়ী এক বছর সমান ৩৬৫.২৪২০ দিন। অর্থাৎ, বছরের হিসাবে মায়ানদের হিসাবটিই ছিল প্রকৃত হিসাবের অনেক কাছাকাছি। এটা সত্যিই অবাক করার বিষয় যে, খ্রিস্টপূর্ব সময়েই মায়ানরা বছরের এত নিখুঁত হিসাব করেছিল। মায়ানদের হিসাব মতে, ২৩৯২ দিনে ৮১টি চন্দ্রমাস হয়। অর্থাৎ একটি চন্দ্রমাসের দৈর্ঘ্য ২৯.৫৩০৮ দিন। আধুনিক বিজ্ঞান বলে, ২৯.৫৩০৫৯ দিনে একটি চন্দ্রমাস হয়। অর্থাৎ হাজার হাজার বছর আগেই মায়ানরা সঠিক চন্দ্রমাস গণনা করতে সক্ষম হয়েছিল।
পোস্ট ক্লাসিক সময়ে মায়াদের শক্তিশালী শহরগুলো পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হয়। শহরগুলোর হঠাৎ পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হওয়ার পেছনে কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া না গেলেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনকে ধরে নেয়া যায়। খালি শহুরে অংশগুলো নতুন গোষ্ঠী টলটেক্সরা দখলে নেয় এবং পুনরায় বসতি স্থাপন করে। এই যুগে প্রভাবশালী শহরে পরিণত হয় তুলা এবং চিচেন-ইতজা শহর। কিচ মায়ানদের পরাজয় ঘটে ১৫২৪ সালের উতাতলান এর যুদ্ধে এবং এই সালকেই মায়া সভ্যতার শেষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১১৯
আপনার মতামত জানানঃ