প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর মাথায় ঝুলছে লক্ষাধিক মামলার খড়গ।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির যত এগিয়ে যাচ্ছে তত বিএনপির বিরুদ্ধে পুরনো মামলাগুলো সচল হচ্ছে। পাশাপাশি দায়ের করা হচ্ছে নতুন মামলা। গত একমাসে বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭৫ টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে।
এই মামলাগুলো শুধু রেকর্ড নয়, মামলাগুলোর তদন্ত এগিয়ে নেওয়া এবং মামলাগুলোতে চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
পাশাপাশি পুরনো যে মামলাগুলো রয়েছে সেই মামলাগুলো সচল করা হচ্ছে এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকার পরও যাদেরকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরিভাবে বলে দিয়েছেন যে, যারা অগ্নিসংযোগ লুটপাট করেছে, বাসে আগুন দিয়েছে, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তাদেরকে ছাড়া হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো সচল করতে হবে এবং তাদেরকে অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। এই তদন্ত গুলো শেষ করতে হবে।
‘খুনি, অগ্নিসন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আইন তার আপন গতিতে চলবে’ বলে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসব সন্ত্রাসী এতদিন লুকিয়ে থাকলেও বিএনপির সঙ্গে মাঠে নামবে, সতর্ক করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, জীবন্ত মানুষ হত্যা করেছে, হাত কেটেছে, চোখ তুলেছে, মানুষকে নির্যাতন করেছে; তাদের ছাড় নেই। এসব আসামিকে ধরতে হবে। আইন তার আপন গতিতে চলবে।’
প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের পর পরই নড়েচড়ে বসেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সূত্র মতে, ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়ে বিএনপির বিভিন্ন নেতাদের বিরুদ্ধে চার হাজারের কাছাকাছি মামলা রয়েছে (৩৯১৮ টি)। এছাড়াও বিভিন্ন রকম অপরাধের কারণে বিএনপির বিভিন্ন নেতারা আরও ১৯৫ টি মামলার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত।
এই চার হাজার মামলার মধ্যে খুব কম মামলাই নিষ্পত্তি হয়েছে। হিসাবপত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ২০১৩ সালে যে প্রায় দেড় হাজার মামলার মধ্যে মাত্র ২৭ টি মামলার চার্জশিট হয়েছে, বাকি মামলাগুলোর আর চার্জশিট হয়নি। এই সমস্ত মামলায় ১০ লাখের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল।
তবে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে খুব কম সংখ্যক মানুষ। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই পুরনো মামলার ফাইল গুলোকে আবার সামনে নিয়ে আসছে এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
বিএনপি যে সমাবেশগুলো করছে সেই সমাবেশগুলোতে অনেক পরোয়ানাভুক্ত ব্যক্তিকে পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে এবং সেই সমস্ত পরোয়ানাভুক্ত ব্যক্তি গুলোকে চিহ্নিত করে তাদেরকে গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২০১৩ সালে বাসে অগ্নিসংযোগ, গান পাউডার দিয়ে মানুষ পুড়ানো সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসের অভিযোগে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল কিন্তু চার্জশিট হয়নি সেই মামলাগুলোকে এখন দ্রুত তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি যে রাজনৈতিক কর্মসূচি গুলো পালন করছে, সেই কর্মসূচি গুলো পালন করতে গিয়েও বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাস এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটছে এবং এ সমস্ত সন্ত্রাস সহিংসতার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯৭ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জ, ভোলা, ঢাকা শহরের মামলাগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
আর এই মামলাগুলো যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং যারা অভিযুক্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ১১৮ টি মামলা রয়েছে। তবে সবগুলো মামলায় তিনি জামিনে আছেন। এখন এই জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করা হবে, মামলাগুলোর চূড়ান্ত চার্জশিট দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে।
এছাড়া অন্যান্য প্রতিটি নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এই মামলাগুলোকে সচল করা এবং নতুন মামলাগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিরোধী দলকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবেই সরকারের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ভোটের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। তবে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর মাথায় ঝুলছে লক্ষাধিক মামলার খড়গ।
শীর্ষ থেকে নিয়ে তৃণমূল, আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন এমন বেশির ভাগ নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে অগণিত মামলা। এই অবস্থায় দলটি আন্দোলনে কতটা সুবিধা করতে পারবে সেটা নিয়ে ভেতরে-বাইরে দেখা দিয়েছে সংশয়। যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, এসব মামলা সত্ত্বেও তারা আন্দোলনে পিছপা হবেন না।
বিএনপির দফতর সূত্র জানায়, দলটির প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এক লাখ ৬০৯টি মামলা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি দলটির যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। তার নামে রয়েছে পাঁচ শতাধিক মামলা। সাবেক ছাত্রদল নেতা ইসহাক সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে তিন শতাধিক মামলা। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শখানেক মামলার আসামি। সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগই মামলার আসামি।
বিএনপির দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে চলতি বছরের ১৭ মে পর্যন্ত করা এসব মামলায় আসামি প্রায় ৩৫ লাখ ৭৭ হাজার ৮৫৭ নেতাকর্মী। এছাড়া এই সময়ে অন্তত এক হাজার ৫২৯ জনকে হত্যা এবং কমপক্ষে এক হাজার ২০৪ জনকে গুম করা হয়েছে। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ১১ হাজার ৩২৬ জনকে গুরুতর জখম ও আহত করা হয়েছে বলে দাবি দলটির।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২০
আপনার মতামত জানানঃ