গত এক বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। ৪৮ বিলিয়ন ডলারে ওঠা রিজার্ভ এখন নেমে এসেছে ৩৫ বিলিয়নে। স্বল্প সময়ে রিজার্ভের এ অস্বাভাবিক ক্ষয়ের কারণ হিসেবে নীতিনির্ধারকরা ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে আসছিলেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রই তুলে ধরছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস আগেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয় হতে শুরু হয়। এর সূত্রপাত রিজার্ভ থেকে অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রির মাধ্যমে।
গত বছরের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ১ হাজার ২০৭ কোটি বা ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু চলতি বছরই ৯৫৯ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। আমদানি দায় ও বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপের কারণেই রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাই পর্যন্ত বাজার থেকে ডলার কেনার ধারায় ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৩১ কোটি ডলার বিক্রি করা হলেও পরে তা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর তিন মাসে বিক্রি করা হয়েছিল ১৫৪ কোটি ডলার।
আর চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে ১৫৬ কোটি ও এপ্রিল-জুনে ৩৫৮ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকে প্রতি মাসে বিক্রি করতে হচ্ছে দেড় বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুলাই থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয়েছে ৪৪৫ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দিন যত যাচ্ছে বিদেশী ঋণ ও এলসি পরিশোধের চাপ ততই বাড়ছে। এখন প্রতি মাসে ১৫০ কোটি ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের চাপ যেভাবে বাড়ছে, তাতে বছরের বাকি সময়ে মাসে ডলার বিক্রির পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। এতদিন রিজার্ভের পতন যে গতিতে হয়েছে, আগামীতে সেটি আরো বাড়বে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, বরং রিজার্ভের পতনকে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফল বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর কোনো সংস্কার হয়নি।
বরং এ সময়ে অর্থনৈতিক কাঠামোগুলো আরো বেশি দুর্বল হয়েছে। সরকারের কর-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে কমেছে। অথচ দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমানকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। এখন অর্থনীতির সব দুর্বল দিক একসঙ্গে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানোর জন্যই রিজার্ভের পতন হচ্ছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি, বিদেশী ঋণপ্রবাহ আর নিট রফতানি আয় বাড়ার কারণে গত কয়েক বছর ডলারের স্থিতাবস্থা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন বিদেশী ঋণপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। আবার রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ও পতনের দিকে।
আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকারের চলতি হিসাবের ভারসাম্য আরো বড় ঘাটতির দিকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে, সেটি কোনো মৌসুমি ব্যাপার নয়। বরং কাঠামোগত সমস্যার কারণে এ সংকট শুরু হয়েছে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এ সংকট থেকে উত্তরণের আগাম পরিকল্পনা নেননি। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উপস্থিত পরিকল্পনায়ও যথেষ্ট ঘাটতি আছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের বিস্তৃতি ততই বেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পরই বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে জ্বালানি তেলসহ খাদ্যপণ্যের দাম। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও।
গত আগস্টে দেশে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাপেই অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়। সরকারি হিসাবেই গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। যদিও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম ২৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
গত অর্থবছরে রেকর্ড ৮৯ বিলিয়ন ডলারের আমদানি এলসি খোলে দেশের ব্যাংকগুলো। ইতিহাসের সর্বোচ্চ এ এলসি দায় পরিশোধের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে ব্যাংকগুলো বর্তমানে দিশেহারা পরিস্থিতি পার করছে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তীব্র ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যাংক চাইলেও যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আবার বিদেশী ঋণের কিস্তির ডলার সংস্থান করতে পারছে না কোনো কোনো ব্যাংক। এ অবস্থায় প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। গত বছরের আগস্টে বাজার থেকে ডলার কেনা বন্ধ হয়ে যায়। এর পর থেকে টানা ১৫ মাস ধরে বাজারে ডলার বিক্রি করে চলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২১ সালে বাজার থেকে মোট ২৬৬ কোটি ডলার কিনে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ডলার কেনা হয়েছিল জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত। এর পর থেকে প্রতি মাসেই বাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। বছর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিক্রি করা ডলারের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৫২ কোটি ডলারে।
এ হিসাবে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট ডলার বিক্রি ছিল ১৪ কোটি ডলার। চলতি বছর বাজার থেকে কোনো ডলার কেনার সুযোগই পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানুয়ারি থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক মোট ৯৫৯ কোটি ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করেছে। অব্যাহতভাবে ডলার বিক্রি করায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
গত বুধবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও নিট রিজার্ভ প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে দেশে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা। বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতি ডলারের দর ছিল ১০৫ টাকা। যদিও দেশের খুচরা বাজারে এ দরে ডলার মিলছে না। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের জন্য গুনতে হচ্ছে ১১৫ টাকারও বেশি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা পেলেও বাজার স্থিতিশীল হবে না বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের চার মাসেই রিজার্ভ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়েছে। তার মানে আইএমএফের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ আমাদের সংকট নিরসনে একেবারেই যৎসামান্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবল সরকারি এলসি ও ঋণ পরিশোধের জন্য ডলার বিক্রি করছে। এর পরও যদি এত ডলার বিক্রি করতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরো খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে এখন ডলারের বিনিময় হার বিভিন্ন ধরনের। এক্সচেঞ্জ হাউজের বাইরে অন্য সব রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের সর্বোচ্চ দর ৯৯ টাকা। এক্সচেঞ্জ হাউজের রেমিট্যান্সের দর ১০৭ টাকা। আবার খুচরা বাজারে ডলারের দর ১১৫ টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে ৯৬ টাকায়। এক বাজারে ডলারের এত ধরনের দর হলে পরিস্থিতি কখনই স্বাভাবিক হবে না। বরং দেশে অবৈধ হুন্ডিসহ অর্থ পাচারের প্রবণতা অনেক বেড়ে যাবে। রেমিট্যান্সের বড় ধরনের পতন সে শঙ্কাই সত্য হয়ে ধরা দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫২৫
আপনার মতামত জানানঃ