বেলারুশের মানবাধিকারকর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি এবং যুদ্ধরত দুই দেশ ইউক্রেন-রাশিয়া ভিত্তিক দুই মানবাধিকার সংগঠনকে এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কির সঙ্গে এই পুরস্কার পেয়েছে রাশিয়াভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল এবং ইউক্রেনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজ।
শুক্রবার (০৭ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি পুরস্কার ঘোষণা করে। নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইট নোবেল ডট ওআরজি ও এ-সংক্রান্ত ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়।
নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় বলা হয়েছে, পুরস্কারজয়ী ব্যক্তি ও সংগঠন নিজেদের দেশে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। তারা দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সংরক্ষণে কাজ করছেন। একই সঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকাদের সমালোচানার পাশাপাশি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কাজ করছেন তারা।
এতে বলা হয়, শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য নাগরিক সমাজের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন নোবেল জয়ী ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে নথি তৈরিতে তারা দেখিয়েছেন অসাধারণ কর্মদক্ষতা।
অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি
অ্যালেস বেলারুশের মানবাধিকারকর্মী। তার বয়স ৬০ বছর। তিনি বর্তমানে দেশটির কারাগারে আছেন। বিচার-পূর্ব আটকাবস্থায় আছেন তিনি।
অ্যালেস দেশটির ভিয়াসনা হিউম্যান রাইটস সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। মানবাধিকার সংগঠনটি ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বেলারুশের রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ওপর দেশটির কর্তৃত্ববাদী নেতা আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর নৃশংস দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
অ্যালেস সম্পর্কে নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি বলেছে, তিনি ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি বেলারুশের গণতন্ত্র আন্দোলনের সূচনাকারীদের একজন। নিজের দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ও এবং শান্তিপূর্ণ উন্নয়নে জীবন উৎসর্গ করেছেন তিনি।
এছাড়া বিয়ালিয়াৎস্কি ১৯৯৬ সালে বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রতিক্রিয়ায় ভিয়াসনা (স্প্রিং) নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালের ওই সংশোধনী প্রেসিডেন্টকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়। ফলে ব্যাপক বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। জেলে আটক আন্দোলনকারী ও তাদের পরিবারদের সহায়তা দিয়েছে ভিয়াসনা। পরবর্তীতে ভিয়াসনা মানবাধিকার সংস্থা হিসেবে বিকশিত হয়। সংস্থাটি রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের রেকর্ড নথিবদ্ধ এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ করে।
সরকার বারবার আলেস বিয়ালিয়াৎস্কিকে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। এরপর ২০২০ সালে সরকারের বিরুদ্ধে বড় আকারের বিক্ষোভের পর তাকে ফের গ্রেপ্তার করা হয়। বিয়ালিয়াৎস্কিকে এখনও বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে নানা ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও বিয়ালিয়াৎস্কি বেলারুশের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ে বিন্দুমাত্র দমে যাননি।
শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য নাগরিক সমাজের তাৎপর্য তুলে ধরেছেন নোবেল জয়ী ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে নথি তৈরিতে তারা দেখিয়েছেন অসাধারণ কর্মদক্ষতা।
কর ফাঁকির অভিযোগে ২০১১ সালে অ্যালেসকে প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। এই অভিযোগে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে তিনি কারামুক্তি পান।
বেলারুশে কারচুপির নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভের জেরে ২০২০ সালে অ্যালেসকে আবার আটক করা হয়। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে যান লুকাশেঙ্কো।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির চেয়ার বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসেন বলেছেন, অ্যালেস বেলারুশে মানবাধিকারের জন্য তার লড়াইয়ে এক ইঞ্চিও ছাড় দেননি।
সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস (সিজিএস)
সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস (সিজিএস) ইউক্রেনের একটি শীর্ষ স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন।
২০০৭ সালে সিজিএস প্রতিষ্ঠিত হয়। দখলকৃত ক্রিমিয়ায় রাজনৈতিক নিপীড়ন পর্যবেক্ষণ করে আসছে সিজিএস।
সংগঠনটি দনবাস যুদ্ধের সময় সংগঠিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নথিভুক্ত করেছে। তারা ক্রেমলিনের রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার চালিয়ে আসছে।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এই হামলার পর থেকে সংগঠনটি ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ শনাক্ত ও নথিভুক্তের প্রচেষ্টায় নিযুক্ত রয়েছে।
মেমোরিয়াল
মেমোরিয়াল রাশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংগঠনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৯৮৭ সালে মেমোরিয়াল প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাত্র চার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় মেমোরিয়াল।
মেমোরিয়াল রাশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো মানবাধিকার সংগঠন। তারা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সোভিয়েত–যুগে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কাজ করেছে। তারা রাশিয়ার মানবাধিকার নিয়েও কাজ করেছে।
মানবাধিকার সংস্থা মেমোরিয়াল সম্পর্কে জানানো হয়েছে, সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা ১৯৮৭ সালে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মানবাধিকার কর্মীদের হাত ধরে। সাবেক সোভিয়েত শাসকদেরর হাতে নিপীড়নের হওয়া ব্যক্তিদের বিস্মৃত হতে না দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এ সংস্থার পত্তন।
মেমোরিয়ালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আন্দ্রেই সাখারভ ও মানবাধিকারকর্মী সভেৎলানা গানুশকিনাও ছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মেমোরিয়াল রাশিয়ার বৃহত্তম মানবাধিকার সংস্থায় পরিণত হয়। স্ট্যালিনিস্ট যুগে নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের ওপর নথিপত্রের একটি কেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি রাশিয়ায় রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তথ্য সংকলন ও সুসংবদ্ধ করেছে সংস্থাটি।
রাশিয়ান বন্দিশিবিরগুলোতে রাজনৈতিক বন্দিদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হয়ে ওঠে মেমোরিয়াল।
চেচেন যুদ্ধের সময় রুশ ও রুশপন্থী বাহিনী বেসামরিক মানুষের যেসব নির্যাতন ও যুদ্ধাপরাধ করেছে, তার তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করে মেমোরিয়াল। এ কাজের কারণে ২০০৯ সালে মেমোরিয়ালের চেচনিয়া শাখার প্রধান নাতালিয়া এস্তেমিরোভা নিহত হন।
গত বছর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার দুই সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।
চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষণা শুরু হয়েছে গত ৩ অক্টোবর। প্রথম দিন চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল জয় করেন সুইডিশ বিজ্ঞানী সোয়ান্তে প্যাবো।
পরদিন মঙ্গলবার ঘোষণা করা হয় পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল। এই বিষয়ে এবার এ পুরস্কার পেয়েছেন তিন দেশের তিন বিজ্ঞানী। তারা হলেন ফ্রান্সের অ্যালাঁ আসপে, যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ ক্লাউসার ও অস্ট্রিয়ার আন্টন সেইলিংগার।
বুধবার রসায়নেও নোবেল পুরস্কার পান তিন বিজ্ঞানী। ‘ক্লিক কেমিস্ট্রি’ ও ‘বায়োঅর্থোগোনাল কেমিস্ট্রি’র ভিত্তি দিয়ে এ পুরস্কার জয় করেছেন আমেরিকার ক্যারোলাইন আর বারটোজ্জি, কে ব্যারি শার্পলেস এবং ডেনমার্কের মর্টেন মেলডাল।
আর বৃহস্পতিবার এ বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান ফ্রান্সের লেখক অ্যানি এরনোক্স।
অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে ১০ অক্টোবর শেষ হবে এবারের মোট ছয়টি শাখায় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা। আগামী ডিসেম্বরে সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল সপ্তাহে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেয়া হবে পুরস্কারের পদক, সনদ ও অর্থ। সম্মানজনক এই পুরস্কারের অর্থমূল্য এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার (১১ লাখ মার্কিন ডলার)।
সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামে ও তার রেখে যাওয়া অর্থে ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরু হয়। প্রতি বছর চিকিৎসা, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে দেয়া হয় বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৩
আপনার মতামত জানানঃ