রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা ‘রাজউক’-এর কর্মকাণ্ডের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে সংস্থাটির বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ নিয়ে। রাজধানীর নগরায়ণ পরিকল্পনা, নীতিমালা তৈরি এবং সে অনুযায়ী বিষয়গুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করাই রাজউকের মূল কাজ। কিন্তু বিগত দেড়-দুই দশকে বেশ কিছু আবাসন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, জালিয়াতি এবং সেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত আদিনিবাসীদের যথাযথভাবে ক্ষতিপূরণ না দেওয়া নিয়ে বারবার আলোচনায় এসেছে রাজউক। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে প্লট বরাদ্দে বৈষম্য দেখিয়ে।
কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের পরিবারের কেউ আগে প্লট পেয়ে থাকলে নতুন করে তাদের প্লট পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এখন রাজউক যে নিয়ম করতে যাচ্ছে, তাতে কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের স্ত্রী, সন্তান, স্বামী আগে প্লট পেয়ে থাকলেও তারা নতুন করে আরেকটি প্লট পাবেন।
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানায়, রাজউকের প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধন করে এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এর খসড়া তৈরি করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খসড়াটির নাম দেওয়া হয়েছে রাজউক ভূমি বরাদ্দ বিধিমালা-২০২২।
রাজউক এখন প্লট বরাদ্দ দেয় ১৯৬৯ সালের প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বিধিমালা অনুসারে। এই বিধিমালা অনুসারে রাজউক কোনো আবাসিক প্রকল্প নিলে প্লট বরাদ্দের জন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন আহ্বান করে। পরে আবেদন যাচাই-বাছাই করে যোগ্যদের প্লট বরাদ্দ দেয়।
তবে এই বিধিমালায় ১৯৮৬ সালে নতুন একটি উপবিধি (১৩–এ) যুক্ত করা হয়, যা সংরক্ষিত কোটা নামে পরিচিত। এই কোটাতেই মূলত মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের প্লট বরাদ্দ দেয় রাজউক। এই উপবিধিতে বলা হয়েছে, কেউ সরকারি চাকরিতে অবদান, জনসেবা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলে কোটায় প্লট পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। সে ক্ষেত্রে প্লট বরাদ্দ পেতে আগ্রহী ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী কিংবা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সরকার বরাবর আবেদন করতে হয়। সরকারের অনুমোদন পেলে সেটি রাজউকের বোর্ড সভায় বা সাধারণ সভায় উত্থাপন করতে হয়। বোর্ড সভায় প্লট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।
প্লট বরাদ্দ দেওয়া সংক্রান্ত রাজউকের নথিতে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ‘অবদান’ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য থাকে না। ফলে এই কোটায় প্লট বরাদ্দ দিয়ে বিতর্ক হয়। এ ছাড়া ১৯৬৯ সালের বিধিমালার ৯ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছে, প্লট পাওয়ার জন্য আবেদনকারী ব্যক্তির নিজের নামে, স্বামী/স্ত্রীর নামে কিংবা পরিবারের সদস্যের নামে রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কোনো আবাসিক জমি, বাড়ি, প্লট বা ফ্ল্যাট বরাদ্দ কিংবা লিজ পেয়ে থাকলে তিনি প্লট বরাদ্দ পাবেন না।
এমন অনেক ক্ষমতাবান পরিবার আছে, যারা রাজউক থেকে একাধিক প্লট পেয়েছেন। মূলত তাদের জন্যই বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া ক্ষমবানদের প্রতি রাজউকের একধরনের উপহার।
২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত কোটায় রাজউকের প্লট পেয়েছেন অন্তত ২৮৫ জন। তাদের মধ্যে ১৪৯ জনই সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য। প্লট বরাদ্দ পাওয়া সংসদ সদস্যদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও (সংসদ সদস্য) রয়েছেন, যার নিজের নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকা শহরে এক বা একাধিক ফ্ল্যাট আছে।
রাজউকের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলছেন, এবার যে খসড়াটি করা হয়েছে, সেটি পাস হলে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের প্লট দেওয়া নিয়ে আর কোনো বিতর্ক থাকবে না। সরকার চাইলে (প্লট থাকা সাপেক্ষে) সব মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের (স্বনির্ভর) প্লট দিতে পারবে। কারণ খসড়া বিধিমালায় রাজউক এলাকায় প্লট বা বাড়ি থাকলে আর প্লট পাওয়া যাবে না এমন শর্ত নেই।
বরং খসড়ায় বলা হয়েছে, এই বিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন—মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী বা সমমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি এবং জাতীয় সংসদের সদস্যরা সরকারের অনুশাসন সাপেক্ষে আবাসিক প্লট বরাদ্দ পাবেন। তাদের স্ত্রী বা স্বামী ও সন্তানেরা স্বনির্ভর হলে এবং তারা আগে প্লট পেলেও সংসদ সদস্যরা প্লট পাওয়ার যোগ্য হবেন।
জাতীয় সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি ‘সমাজসেবকদের’ প্লট পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে রাজউকের খসড়া বিধিমালায়। এ জন্য ‘নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী’ ও ‘সমাজসেবকদের’ জন্য পৃথক উপবিধি যুক্ত করা হয়েছে। খসড়া বিধিমালার উপবিধি ১১ (চ) অনুযায়ী, কেউ সমাজকর্মী বা সমাজসেবক হলে তিনিও বিশেষ সুবিধায় প্লট পাওয়ার যোগ্য হবেন। কিন্তু উপবিধিতে উল্লেখ নেই, ঠিক কোন ধরনের বা কোন কাজের জন্য একজন ব্যক্তিকে সমাজকর্মী ও সমাজসেবক বলা হবে।
সাধারণত দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনাতেই নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী নির্বাচন করা হয়। বিভিন্ন পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটি দেখা যায়। আর যেভাবে রাজউক প্লট বরাদ্দসংক্রান্ত বিধিমালা সংশোধন করতে যাচ্ছে তাতে মূলত সুবিধা পাবেন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা, এটি অগ্রহণযোগ্য ও বৈষম্যমূলক।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এমন অনেক ক্ষমতাবান পরিবার আছে, যারা রাজউক থেকে একাধিক প্লট পেয়েছেন। মূলত তাদের জন্যই বিধিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া ক্ষমবানদের প্রতি রাজউকের একধরনের উপহার।
তারা বলেন, রাজউক এখন পর্যন্ত যতগুলো প্লট প্রকল্প নিয়েছে, এর মূল সুবিধাভোগী সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তরা। প্লট বরাদ্দের বিধিমালা সংশোধন করে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্লট দিতে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ায় সমাজে বৈষম্য আরও বাড়বে। রাজউকের কাজ করা উচিত এমন মানুষদের নিয়ে, যাদের প্লট কেনার সামর্থ্য নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৬
আপনার মতামত জানানঃ