বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে অনেকটাই আড়ালে চলে গিয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এ সময়টাকে জঙ্গিরা কাজে লাগিয়েছে অনলাইনে সদস্য সংগ্রহের কাজে। সাধারণ ছুটির পর জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মুখপাত্ররা বিভিন্ন এনক্রিপটেড অ্যাপে (গোপনীয়তা নিশ্চিত করা যায় যে অ্যাপগুলোয়) চ্যানেল খুলে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কারণে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কোনো সুযোগ পাচ্ছে না জঙ্গি সংগঠনগুলো। তবে বিভিন্ন সময় তারা অনলাইনে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন ক্লোজ গ্রুপে যোগাযোগ ও সদস্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর বাসা থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা জঙ্গি দমনে আরেক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে সাত তরুণ নিখোঁজ হয়। তারা কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে, এমন তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সাতজনের পর তাদের আরও চার সহপাঠী বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের উদ্ধার করে। ডি-রেডিক্যালাইজেশন মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় তাদের।
ওই চারজন জানায়, কথিত হুজুরের দিকনির্দেশনায় তারা বাসা থেকে বের হয়ে যায়। গোয়েন্দারা বলছেন, বিভিন্ন ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতে কনটেন্ট আপ করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। এমনকি অনলাইনে জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সংগ্রহের কাজও চালিয়ে আসছে সংগঠনের সদস্যরা। অনলাইনে অন্যান্য সহযোগীর আইডির সঙ্গে এনক্রিপটেড অ্যাপের মাধ্যমে জিহাদ ও কমব্যাট প্রশিক্ষণের ভিডিও এবং জিহাদের ময়দানে শরিক হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি দেশবিরোধী পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা।
জানা যায়, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর গোপনীয়তা। এই গোপনীয়তাকে পুঁজি করে অসাধু গোষ্ঠী বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছে এনক্রিপ্টেড অ্যাপ। জঙ্গি সংগঠনগুলো সদস্য সংগ্রহ, প্রচারণা এমনকি প্রশিক্ষণও দিচ্ছে এসব এনক্রিপটেড অ্যাপ ব্যবহার করে। এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীরাও এসব অ্যাপ ব্যবহার করে চালিয়ে যাচ্ছেন চোরাচালানসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে এনক্রিপটেড অ্যাপ নির্মাতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনও তথ্য দেয় না। তবুও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে অনেক সময় অনেককে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
জঙ্গি দমনে কাজ করা পুলিশের বিশেষ বাহিনী এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) বলছে, চলতি বছর ২৫টির বেশি অভিযান পরিচালনা করে ৩২ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের মধ্যে জেএমবি এবং আনসার আল ইসলামের সদস্য সংখ্যা বেশি। গ্রেপ্তারকৃতদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এনক্রিপটেড অ্যাপের মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতো। অনলাইনে তরুণদের রেডিক্যালাইজড করে তরুণদের দলে টানতো।
এনক্রিপটেড অ্যাপের মাধ্যমে জিহাদ ও কমব্যাট প্রশিক্ষণের ভিডিও এবং জিহাদের ময়দানে শরিক হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি দেশবিরোধী পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা।
সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে, জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম ছাড়াও মাদক ব্যবসায়ীরাও নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে ব্যবহার করছে এনক্রিপ্টেড অ্যাপ। যে কারণে অপরাধীদের ধরতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
পুলিশ কী করছে
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ইন্টারপা সম্মেলনে আলোচনায় এনক্রিপটেড অ্যাপের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা হয়। ইন্টারপার মাধ্যমে কিভাবে এসব বিষয়ে তথ্য পাওয়া সম্ভব সে বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দেশের সদস্যদের আরও কিভাবে প্রশিক্ষিত করা যায় সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের পুলিশ স্টাফ কলেজের প্রধানদের সমন্বয়ে তথ্যপ্রযুক্তির নানা খুঁটিনাটি বিষয় আরও কী কী সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এছাড়া যেহেতু ইন্টারপা বিভিন্ন দেশের পুলিশ স্কুলের সমন্বয়ে একটি সংগঠন সে কারণে অন্যান্য দেশের পুলিশিং এবং তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের দক্ষতা সম্পর্কেও আমাদের পুলিশ সদস্যরা জ্ঞান অর্জন করতে পারছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির এই পর্যায়ে এসে হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন এনক্রিপটেড অ্যাপের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্তের বিষয়টি অনেকটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের ব্যবহৃত এনক্রিপ্টেড অ্যাপ খতিয়ে দেখে তাদের অপরাধের ধরণ এবং কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হতে পারছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরবর্তীতে এসব অপরাধীদের সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত সেসব বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে এনক্রিপটেড অ্যাপস। এসব অ্যাপসের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি সুরক্ষার জন্য তথ্য দিতে চায় না। তারপরও আমরা তথ্য প্রযুক্তির নানা বিষয় পর্যালোচনা করে অপরাধী শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনছি।
১৯৮৬ সালে মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর উত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা। ১৯৯২ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে বোমা হামলা চালিয়ে সহিংস উগ্রবাদের সূচনা করে দলটি, ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা হামলা ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলাসহ ১৬টি হামলায় ১৪৫ জনকে তারা হত্যা করে।
বর্তমানে তৎপরতা আছে ২০০০ সালের দিকে গঠিত জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ, (যেটিকে পুরোনো জেএমবি বলা হয়), নব্য জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও হিযবুত তাহরীরের। তৎপর এই চারটি সংগঠনই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ভাবাদর্শ অনুসরণ করে থাকে। ফলে বিশ্লেষকেরা বাংলাদেশকে ঝুঁকির বাইরে রাখতে চাইছেন না।
অবশ্য ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদী কার্যক্রম বাংলাদেশের বাইরের দেশগুলোর জঙ্গি তৎপরতার ওপর নির্ভর করে। নিউজিল্যান্ডে মসজিদে হামলা ও শ্রীলঙ্কায় জঙ্গি হামলার পর বাংলাদেশে জঙ্গিদের মধ্যে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা দেখা গেছে। সেদিক থেকে সতর্ক থাকার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, জঙ্গিদের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সবকিছু জানা যাচ্ছে না। যতদূর ধারণা করা যায়, জঙ্গিরা তাদের কার্যক্রমের ধরন বদলেছে। তারা ডার্কওয়েব ব্যবহার করছে। যেখানে নজরদারির সুযোগ সামান্যই। এ বিষয়ে বাহিনীকে আরও চৌকস এবং প্রযুক্তির সাথে নিজেদের আপডেট রাখতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২২৪
আপনার মতামত জানানঃ