অর্থনীতিতে সবচেয়ে অজনপ্রিয় সূচক মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করে এ সূচক। সরকারও সবচেয়ে বেশি ভয় পায় মূল্যস্ফীতিকেই। সূচকটি একটা সরকারকে সহজেই অজনপ্রিয় করে তুলতে পারে। আসলে কেউই চায় না মূল্যস্ফীতি বাড়ুক।
মূলত নির্দিষ্ট একটি সময়ে মূল্যস্তর বেড়ে যাওয়াই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এভাবে বলা যায়, যত পণ্য কিনি তার গড় মূল্য বেড়ে গেল, কিন্তু আয় থেকে গেল একই রকম। যাদের আয় কম বা সীমিত, তারাই মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে। মূল্যস্ফীতি ঘটলে সঞ্চয়ও নিরুৎসাহিত হয়।
সারা বিশ্বে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং মানুষের আয় কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়। মানুষ এখন আগের চেয়ে কম খরচ করছে। তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই প্রবণতা আগামী বছরও থাকতে পারে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি সামাজিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে। মূল্যস্ফীতির চাপ আগামী বছর কিছুটা কমে আসতে পারে। তবে আরো অন্তত তিন বছর পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। আগামী বছরও প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার এই প্রবণতা থাকতে পারে। করোনার প্রকোপ কমতে শুরু করলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য নতুন আশঙ্কা তৈরি করেছে। পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এর প্রভাবে সারা বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে হু হু করে।
খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাবে জীবনযাত্রার সংকট তৈরি করছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। শুধু উৎপাদন কম হওয়া এবং পরিবহন খরচ বেশি, এই কারণেই নয়। রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করার ফলেও খাদ্যসংকট নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক দেশ চাইছে খাদ্যের মজুত ধরে রাখতে। তাছাড়া খাদ্যপণ্য রপ্তানিতেও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
জরিপে ১০ জনের মধ্যে সাত জন অর্থনীতিবিদ বিশ্ব মন্দার আশঙ্কা করেছেন। ১০ জনের মধ্যে অন্তত ৯ জন অর্থনীতিবিদ আশঙ্কা করছেন আগামী বছর ইউরোপের অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপ হবে। বড় অর্থনীতির দেশগুলো মূল্যস্ফীতি রোধ করতে মুদ্রানীতি কঠোর করে যাচ্ছে। দেশগুলো নীতি সুদহার বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে সরবরাহের ঘাটতির কারণেও পণ্যের দাম বাড়ছে। প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হচ্ছে, খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাবে জীবনযাত্রার সংকট তৈরি করছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে।
জরিপে ৭৯ শতাংশ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে পারে। জরিপে ২০ শতাংশ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতেও এই অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, জাহাজ ভাড়া বেড়েছে, এলসি (ঋণপত্র) খরচ বেড়েছে। অতএব, জানা কথা, জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যস্তর দেশীয় বাজারে রক্ষিত হয় না। ওখানে দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে দাম বাড়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তার কোনো সুফল আমরা পাই না। বাজেটের সময়ও তাই। বাজেটে কর হ্রাস পায়, কিন্তু পণ্যের দাম বাজারে কমে না। অথচ কর একটু বাড়লেই সঙ্গে সঙ্গেই মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। বাজারের এই ‘অত্যাচার’ এক অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে/যাচ্ছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে বৃদ্ধি পায় জ্বালানি তেলের দর। এতে মূল্যস্ফীতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে পারে, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকেই মুদ্রানীতির সাহায্য নিয়ে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তারা মনে করেন। পাশাপাশি কমাতে হবে মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা। কেননা, মূল্যস্ফীতি বাড়বে—এই প্রত্যাশা থাকলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে।
তারা বলেন, এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে, তা আমরা কেউ জানি না। তাহলে কি ধরে নেওয়া যায়, মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে? জিনিসপত্রের দাম যে স্তরে উঠেছে, তা থেকে আর নামবে না? না নামলেই বিপদ, যদি না মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, আয় বৃদ্ধি পায়। কর্মহীনতা, বেকারত্ব, চাকরিচ্যুতি ইত্যাদি যদি ঘটতেই থাকে, তাহলেই বিপদ। বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। মধ্যবিত্ত হবে নিম্নবিত্ত। নিম্নবিত্ত হবে বিত্তহীন। দরিদ্র হবে অতিদরিদ্র। আর মূল্যস্ফীতিতে যারা লাভবান হয়, সেই অতিধনীরা হবে আরও ধনী। তাদের অনেকেই পাচার করবে অর্থ। সিঙ্গাপুর, দুবাই, আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় বসতি গাড়বে তারা। দুর্বলরাই থাকবে দেশে!
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৮
আপনার মতামত জানানঃ