সাম্রাজ্যবাদ এবং মানুষের ভাষার ব্যাপক পরিবর্তনের সাথে সাথে মিডিয়ার ধারণা বদলাতে থাকে। ২০০০-এর দশকেও কোনো সংবাদের জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। কখন সংবাদপত্রগুলো আসবে, আর কখন জানা যাবে দেশ ও বিদেশের খবর। সেকালে আজকের মতো সার্চ ইঞ্জিনের এতো সংবাদের সহজলভ্যতা ছিল না। ইয়াহু এবং গুগল সবেমাত্র পরিচিতি পেয়েছে। তবে এটি তখনও আজকের মতো বিকশিত হয়নি।
অন্যদিকে, ফেসবুক, টুইটার, আইফোন তখনও উদ্ভাবিত হয়নি। তাহলে কল্পনা করুন আজকের দুনিয়ার সংবাদ পাঠ এবং ছড়িয়ে দেয়ার সাথে তখনকার সময়ের পদ্ধতির পার্থক্য কেমন ছিল! ইতিহাসবিদরা সংবাদপত্রের সময়কে ৩ ভাগে ভাগ করেছেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন গণমাধ্যমকে বলা হয় প্রোটো-মিডিয়া। সে সময় মানুষ শুধু তার কার্যকলাপের মাধ্যমে তাদের বার্তা ছড়িয়ে দিতো। বক্তৃতা, মৌখিক এবং ম্যানুয়ালি লিখিত আকারে সে সময় সংবাদ পাঠানো হতো। যার কাছে সংবাদ পৌঁছাত তিনিই শুধু সংবাদ শুনতে বা পড়তে পারতেন। আর এই কারণেই ওই সময়ের সংবাদ শুধুই নির্দিষ্ট গোত্র বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর ধীরে ধীরে মিডিয়ার বিবর্তন সংবাদকে নিয়ে এসেছে আমাদের আঙুলের ডগায়।
অ্যানালগ মিডিয়া
কাগজ আবিষ্কার গণমাধ্যমের কাঠামো ঠিক যতোটা পরিবর্তন করেছে তার চেয়ে বেশি সম্প্রসারণ হয়েছে মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের কারণে। এরপর ধীরে ধীরে রেডিও, টেলিভিশন ও কম্পিউটার আবিষ্কার জনসাধারণের মাঝে সংবাদ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও সস্তা ও সহজলভ্য করে তোলে। তবে সংবাদপত্র ছাড়াও ওই সময়টাতে বই ও ম্যাগাজিনের উল্লেখযোগ্য চাহিদা ছিল। কিন্তু এখানে বাধ সাধে মানুষের আয় এবং ব্যয়ের হিসাবনিকাশ।
সেকালে বই মুদ্রণ এবং টেলিভিশনের সংবাদ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করার জন্য প্রচুর অর্থ এবং পরিকাঠামোর প্রয়োজন পড়ত। আর পাঠকদের এসবের সেবা বা অ্যাক্সেস পেতে প্রচুর অর্থ খরচ করার প্রয়োজন হতো। আর এই কারণেই অ্যানালগ যুগে সংবাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রাহক ছিলেন বড় কর্পোরেশন, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং দারোয়ানরা। সাধারণ নাগরিকরা পত্রিকা পেতেন, তবে দুয়েকদিন পরে যখন এগুলো সস্তা হয়ে উঠত।
মিডিয়ার এই প্রক্রিয়াটিকে একমুখী যোগাযোগ মাধ্যম বলেন ইতিহাসবিদরা। কারণ এখানে সংবাদ প্রকাশক শুধুই প্রচার করছেন। কিন্তু পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানার কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি। তবে সংবাদের সত্যতা জানার জন্য সেকালে সম্পাদককে চিঠি পাঠানো যেত কিংবা রেডিও স্টেশনে ফোন করে নিজের প্রতিক্রিয়া জানানোর একটি পথ ছিল। কিন্তু কখনোই এটিকে পরিপূর্ণ মিডিয়া ব্যবস্থা বলতে নারাজ আজকের যুগের প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ।
ডিজিটাল মিডিয়া
মিডিয়ার বিকাশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত হতে পারে তবে অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল মিডিয়ায় প্রবেশের ফলে আমাদের গণমাধ্যমের যে কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
দুই দশক আগেও ভাবা হতো অ্যানালগ মিডিয়া হয়তো আমাদের জন্য সর্বাধুনিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করছে। রাত পেরুলেই জানা যেত আগের দিনের সব ঘটনা। আজকের যুগের প্রভাবশালী যতো পত্রিকা এবং মিডিয়া হাউস সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে রাজত্ব করছে সবগুলোই অ্যানালগ মিডিয়ার যুগে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সবকিছুকে পেছনে ফেলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের রাতারাতি বিকাশের ফলে আমরা এখন পরিপূর্ণ ডিজিটাল মিডিয়া জগতে রয়েছি।
এই সময়ের ফেসবুক, টুইটারসহ সকল মাধ্যমে যে কোনো সংবাদ পাওয়া যায় মুহুর্তের মধ্যে। তবে ডিজিটাল মিডিয়ার সবচেয়ে ভালো দিক হলো অ্যানালগ যুগের অধিকাংশ গণমাধ্যমই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর ভিত্তি করে নিজেদের বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
এতে করে সংবাদদাতা এবং পাঠকের মধ্যে আগের চেয়েও দূরত্ব যেমন কমেছে তেমনি একটি খবর নিয়ে মানুষের মাঝে উদ্দীপনাও ছড়ানো যাচ্ছে ব্যাপক হারে। আবার এই মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রচার করা হচ্ছে খবর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিপ্লবের শেষ সংযোজন হলো টিকটক। চীনভিত্তিক ওই প্ল্যাটফর্মে ছোট ছোট ভিডিও আকারে সংবাদ প্রচারের দিকে ঝুঁকছে পত্রিকাগুলো।
যাইহোক, প্রতিটি নতুন বিপ্লব কিছু সুবিধা ও অসুবিধা নিয়ে আসে। তবে এই কথা সত্য যে দিনের পর দিন মিডিয়ার প্রসার যেমন ঘটছে তেমনি সংবাদ আদান প্রদান আরও সহজতর হচ্ছে। কানেক্টেড মিডিয়ার একটি বড় গুণ ছিল এটি সংবাদ শুধু পড়া নয়, শোনার পথও তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু এখানে খবরের সত্যতা নিশ্চিতের একটি বিশাল ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ সামাজিক মাধ্যমগুলো প্রচারের কাজই করছে। কিন্তু খবরের বস্তুনিষ্ঠতা যেমন যাচাই করে না তেমনি এর প্রভাব সম্পর্কেও সচেতনতা নয়।
আবার এই মাধ্যমগুলো মিডিয়ার নিয়মকানুনের তোয়াক্কা একেবারেই করে না। এতে করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের পাশাপাশি অযাচিত অনেক সংবাদই হু হু করে ছড়িয়ে পড়ছে।
ডেটা মিডিয়া
২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ডেটার পরিমাণ ১৬০০ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে গবেষকদের ধারণা। প্রথমবারের মতো উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডেটা মানুষের জন্য মুক্ত করা হয়েছে। এতে করে তথ্য সংরক্ষণ এবং যাচাই করার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। এখন তথ্যের মালিকানাও ব্লকচেইনে ট্র্যাক করা যায়। মানুষ এখন সংযুক্ত মিডিয়া থেকে উদ্ভূত সামাজিক ত্রুটি সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হচ্ছে।
এই ডেটা মিডিয়ায় সংবাদের স্বচ্ছতা এবং বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করে। আবার যদিও এসব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে তা নিয়ে আলোচনারও সুযোগ দেয়া হয়। আমরা কীভাবে জানব যে উল্লেখিত ডেটা বৈধ এবং সত্য? এই ক্ষেত্রে ডেটা সবসময় সত্য প্রমাণে ব্যস্ত থাকবে।
আজকাল মানুষ প্রচুর পরিমাণে ডেটার অ্যাক্সেস পেয়ে থাকে। এতে করে রিপোর্টিং, বিশ্লেষণ, ধারণা এবং অন্তর্দৃষ্টিগুলো সবসময় আমাদেরকে আরও বেশি সত্য জানার সুযোগ দিচ্ছে। ওয়েব থ্রি এবং বিকেন্দ্রীভূত লেজার আমাদেরকে প্রয়োজনমত বিশ্বাস, অ্যাট্রিবিউশন, জবাবদিহিতা এবং এমনকি সামগ্রীর মালিকানা প্রদান করার অনুমতি দেয়। শুধু তাই নয়, এটি মিডিয়ার মধ্যস্থতাকারীদের সরিয়ে দিতে পারে।
স্বাধীনভাবে ডেটার অ্যাক্সেস পাওয়ায় একটি সম্ভাব্য নতুন ইকোসিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। ডেটা মিডিয়ায় ওপেন সোর্স সফটওয়্যার শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এতে করে আমরা চাইলেই ডেটার মালিকানা দাবি করতে পারব কিংবা সমন্বয় করতে পারবো। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ডেটা মিডিয়ায় মতামতের উপর এবং তথ্যের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে।
কিন্তু পক্ষপাতিত্ব কমাতে হলে নিজেদেরকে অতিরিক্ত ডেটার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু মানুষ কখনই এটা করবে বলে মনে হয় না। বরঞ্চ এগুলো শুধুই মানুষের মত প্রকাশের হার আরও বাড়িয়ে তুলবে। এছাড়াও এভাবে এটি বৈশ্বিক মানে পৌঁছাবে এবং যোগাযোগকে আরও সহজ করে তুলবে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ