অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ চার হাজার ৫৮১ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের মার্চ শেষে এ ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৩২৩ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় আট লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সংখ্যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২১ শতাংশ।
দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরকারের বিদেশী ঋণ। বাড়ছে সুদসহ ঋণ পরিশোধের চাপও। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারকে বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১১২ কোটি ডলার। পাঁচ বছর পর বিদেশী ঋণ পরিশোধের এ চাপ দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সরকারকে সুদসহ ২৭৭ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। আর দুই অর্থবছর পর এর পরিমাণ ৪০২ কোটি বা ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে।
বিদেশী ঋণ পরিশোধের এ চিত্র উঠে এসেছে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এক প্রতিবেদনে। এতে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় কীভাবে সরকারের বিদেশী ঋণ পরিশোধ করা হবে, তা তুলে ধরা হয়েছে। তবে বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ পরিশোধের বিষয়টি এ পরিসংখ্যানে দেখানো হয়নি। একই সঙ্গে এ হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে সরকারি কোম্পানিগুলোর নেয়া বিদেশী ঋণের বিষয়টিও।
ইআরডি আয়োজিত ‘সুশাসন নিশ্চিতকরণে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক সেমিনারে গতকাল দুটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। ‘ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ম্যানেজমেন্ট; প্রেজেন্ট সিনারিও’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের সরকারি খাতে বিদেশী ঋণের স্থিতি ৫৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ৬৬৬ কোটি ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক ঋণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন ভিন্ন তথ্যই দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের মোট বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল ৯৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৬৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারই ছিল সরকারি খাতের ঋণ। সরাসরি সরকারের নেয়া বিদেশী ঋণ ছিল ৫৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার, যার পুরোটাই দীর্ঘমেয়াদি। বাকি ১১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ নিয়েছে সরকারি কোম্পানিগুলো। মার্চ শেষে দেশের বেসরকারি খাতের নেয়া বিদেশী ঋণের স্থিতি ২৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইআরডি থেকে বিদেশী ঋণ পরিশোধের যে পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে, সেটি শুধু সরকারি ঋণকে আমলে নিয়ে করা হয়েছে। এ কারণে ২০২৪-২৫ সালে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দেখাচ্ছে ৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু বিদেশী উৎস থেকে নেয়া সরকারি ঋণের পাশাপাশি এ সময়ে সরকারি কোম্পানি ও বেসরকারি খাতের নেয়া ঋণও সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছর থেকে বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ১০-১২ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, রাজস্ব দিয়ে সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা পর্যালোচনা করলে সরকারের বিদেশী ঋণের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ঋণকে আমলে নিতে হবে। যদি ব্যালান্স অব পেমেন্টের দিক থেকে পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে সরকারি-বেসরকারি সব খাতের বিদেশী ঋণ পরিশোধের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কারণ বেসরকারি যেসব কোম্পানি বিদেশী ঋণ নিয়েছে, সেটি পরিশোধের দায়বদ্ধতাও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকারের। এক বছর পর সরকারের নেয়া বিদেশী ঋণ ৪ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হলে এর সঙ্গে বেসরকারি খাতের ঋণও যুক্ত হবে। বেসরকারি খাতের ঋণের বেশির ভাগেরই ধরন স্বল্পমেয়াদি। এ কারণে আগামীতে প্রতি বছর ১০-১২ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপ দেশের ঘাড়ে পড়বে।
ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বিদেশী ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি ছিল ১৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ ছাড় দেয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতির পরও ছাড় হয়নি এমন বিদেশী ঋণের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারি বিদেশী ঋণের স্থিতি ৫৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণের ৪০ শতাংশ দ্বিপক্ষীয়। বাকি ৬০ শতাংশ ঋণ এসেছে বহুপক্ষীয় বিভিন্ন সংস্থা থেকে।
ইআরডি বলছে, সরকারের নেয়া বিদেশী ঋণের গড় সুদহার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ঋণের গড় গ্রেস পিরিয়ড ৭ বছর ৬ মাস। গড়ে আগামী ২৩ বছর ২ মাসের মধ্যে সব বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে সরকার। একই সময়ে ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ ও অনুদান ছাড় হয়েছে।
ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যই ৫৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণ নিতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদার বিশ্বব্যাংক। বহুজাতিক সংস্থাটি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পের মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৩৩ শতাংশ একাই জোগান দিয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ ঋণের জোগান এসেছে এডিবি থেকে। এছাড়া জাপান ১৭ দশমিক ৭৯, চীন ৮ দশমিক ৪১, রাশিয়া ৮ দশমিক ৯৩ ও ভারত ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ বিদেশী ঋণের জোগান দিয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০১৮
আপনার মতামত জানানঃ