চীনের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের বহুপ্রতীক্ষিত প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেদনে এ উপসংহার টানা হয়েছে, জিনজিয়াং নিয়ে বেইজিংয়ের নীতি মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল হতে পারে।
তবে বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে কিছুটা হলেও ভিন্ন কথা। জিনজিয়াং নিয়ে প্রতিবেদন করতে চীনে অনেক বছর কাটিয়েছেন বিবিসির জন সুডওয়ার্থ। চীন সম্পর্কে তিনি আমাদের কী বার্তা দেয়, তা পরিষ্কার।
জিনজিয়াং গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা তার সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, কে এই চীন? চীন এক উদীয়মান পরাশক্তি। হাঁটছে ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির পথে। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থায়ও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে দেশটি। কিন্তু এ দেশটিই উইঘুরদের পাইকারিভাবে আটক করার এক কঠোর কর্মসূচি চালু রেখেছে। এ দুই বাস্তবতার মধ্যকার সম্পর্ককে আমরা কীভাবে বুঝব?
চীনের বিস্তীর্ণ জিনজিয়াং প্রদেশ আয়তনে জার্মানির প্রায় পাঁচ গুণ। এখানেই উইঘুর জনগোষ্ঠীর বসবাস। চীনের দূর পশ্চিম সীমানা ও পূর্ব–পশ্চিমের সংযোগস্থলে নিজেদের অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছে এই জাতিসত্তার মানুষেরা।
ফর্সা ত্বক, সবুজ চোখ, লাল চুল—উইঘুর জনগোষ্ঠীর সাধারণ শারীরিক বৈশিষ্ট্য। মধ্য এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা উইঘুরদের সংস্কৃতিতে ইসলামি রীতিনীতি–আচার প্রবল।
গত শতকের প্রথম ভাগে জিনজিয়াং দুটি স্বল্পমেয়াদি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের দেখা পেয়েছে। তবে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিক্ষিপ্ত সহিংসতার ছড়াছড়িতে বিচ্ছিন্নতাবাদের লক্ষণ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চীন উইঘুরদের ক্রমে আরও বেশি শুধু সন্দেহের চোখেই দেখছে না; বরং বিপজ্জনক রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবেও বিবেচনা করছে।
চীন বিশাল আকারের সব বন্দিশিবির নির্মাণ এবং উইঘুর পরিচয়, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের যেকোনো অভিব্যক্তি নিশানা করে গণহারে তাদের আটক করা শুরু করে ২০১৭ সালের শুরুর দিকে।
জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদনে উইঘুরদের ওপর নির্যাতন ও জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। এতে করে তাদের জন্মহার নাটকীয়ভাবে কমে এসেছে। এ ছাড়া উইঘুরদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের ওপরও সহিংস দমনপীড়ন চালানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
তবে উইঘুরদের এই দুর্দশার চিত্রগুলোকে চীনের পূর্বে বেইজিং ও সাংহাইয়ে দিন দিন উন্নতির চূড়ায় পৌঁছাতে থাকা শহর ও আকাশছোঁয়া ভবনগুলোর সঙ্গে আমরা কীভাবে মেলাব। মাঝেমধ্যে আশ্চর্য হয়ে পড়তে হয় এটা ভেবে যে আসল চীন কোনটা।
জিনজিয়াং নিয়ে বিবিসির এই প্রতিবেদক বেশ কয়েকটা প্রতিবেদন করেছেন। এর মধ্যে নির্দিষ্ট একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ২০১৯ সালে জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের চারটি বন্দিশিবির পরিদর্শনের জন্য নেওয়া হয়েছিল বিবিসির সাংবাদিকদের। খুব কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রিত ওই সফরে চীনের উদ্দেশ্য ছিল ভুয়া প্রচারণা চালানো। এরপরও উইঘুরদের ওপর চালানো জুলুমের বিষয় চেপে রাখা তাদের জন্য কঠিন ছিল। তবে তারা চেষ্টা করেছিল।
বন্দিশিবিরগুলোতে বিবিসির দলকে উইঘুরদের নাচ দেখানো হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিল যে সেখানে উইঘুররা তাদের রীতিনীতি–সংস্কৃতি উদ্যাপনের দিক দিয়ে একেবারে স্বাধীন। নাচ দেখতে দেখতে বিবিসির এক প্রতিবেদক ওপরের দিকে তাকান। চোখ আটকে যায় সঙ্গে থাকা একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার দিকে। তিনি কাঁদছিলেন। সেটি ছিল আনন্দের কান্না।
ঘটনাটি এই প্রতিবেদককে নাড়া দিয়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনা সরকার এই প্রচারণা বিরাট খারাপ কিছু লুকোনোর জন্য করছে না। তাদের বিশ্বাস, উইঘুরদের রক্ষা করতে তারা ভালো ও মহৎ কাজ করছে। নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি তারা এভাবেই দেখে। অন্যভাবে বলতে গেলে, তারা যে প্রচার–প্রচারণা চালাচ্ছে, তা করছে বিশ্বাস থেকে।
এ আলোকে বলতে গেলে জিনজিয়াংয়ে যা ঘটছে, তা চীনকে সমৃদ্ধ দেশগুলোর লম্বা একটি তালিকায় ফেলেছে। এই দেশগুলো মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন করেছে। এসব ঘটনা বিশেষ করে তখনই ঘটেছে, যখন স্বাধীন আদালত ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের নজরদারি ছিল না। যেসব দেশে ধর্মীয় শাসন রয়েছে, সেসব দেশ থেকে শুরু করে স্বৈরাচারী, এমনকি গণতান্ত্রিক দেশগুলোর এ তালিকা বেশ লম্বা।
জিনজিয়াং নিয়ে সমালোচনার জবাবে চীন প্রায়ই প্রাচীন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দাসত্ব ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসনের প্রসঙ্গই তুলে ধরেছে। এর মানে, সেগুলোই ছিল মানবতার বিরুদ্ধে আসল অপরাধ। কিন্তু এই তুলনা বেইজিংয়ের আত্মপক্ষ সমর্থনে দেখানো যুক্তি থেকে অনেক দূরে।
শক্তিশালী সব দেশই মারাত্মক সব ঘটনা ঘটাতে পারে এবং তারা তা ঘটিয়েও থাকে। আর সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনাগুলো ঘটানো হয় সেগুলো সঠিক মনে করেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ