২০১২ সালে ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে একটি ডেডিকেটেড বাস ট্রানজিট প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। তবে এরপর থেকেই প্রকল্পটির খরচ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। একদিকে প্রকল্প সম্পন্নের মেয়াদ দফায় দফায় বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে খরচও। সর্বশেষ ১০৯ শতাংশ বেড়ে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা, মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক নাম বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি। এই বিআরটি দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ২০ হাজার যাত্রী আরোহী ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গাজীপুর যাবে। কিন্তু দুরদর্শী পরিকল্পনা, দূরদর্শিতার অভাব ও পরবর্তীকালে ব্যয় বৃদ্ধি একটি প্রকল্পকে কতটা ভারসাম্যহীন করে দিতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ এই প্রকল্পটি।
যেকারণে বেড়েছে প্রকল্প ব্যয়
বিমানবন্দর-গাজীপুর বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে শুরু থেকেই পরিকল্পনাকারীরা নানা পরিবর্তন আনছেন। প্রথমে চার লেনের বিআরটি নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরে বিআরটির পরিকল্পনা নেমে আসে দুই লেনে। আরেক সংশোধনীতে বাস স্টেশনের সংখ্যা প্রথমবারের ৩১ থেকে কমিয়ে ২৩টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে।
এছাড়া কর্তৃপক্ষ মনে করছে, টঙ্গী সেতুতে মোটরবিহীন যান ও পথচারীদের জন্য আলাদা লেন প্রয়োজন। প্রথমে এর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়নি তাদের।
বিলম্বিত এই প্রকল্পের কাজ শুরুর দশ বছর পর কর্তৃপক্ষ এখন বিআরটি ও গণপরিবহনের লেন পৃথক করতে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়া দেওয়ার প্রয়োজন উপলদ্ধি করেছে। পাশাপাশি সড়কটির উপরিভাগের পুরুত্বও প্রয়োজনের ভিত্তিতে ১৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে বলে মনে করছে তারা।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় স্টেশনে ফুটওভার ব্রিজের সংখ্যা বৃদ্ধি, সাড়ে ২০ কোটি টাকার বেড়া নির্মাণসহ বিআরটি প্রকল্পের ডিজাইনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছে। হচ্ছে। ডিজাইন পরিবর্তনের মারপ্যাঁচে বাদ যাচ্ছে গাজীপুর এলাকায় কয়েকটি কাঁচাবাজার নির্মাণ ও বিমানবন্দর এলাকায় বিআরটি ব্যবহারকারীদের জন্য ৪২০ কোটি টাকা ব্যয়ে আন্ডারপাস নির্মাণের পরিকল্পনাও।
২০১৬ সালের মধ্যে কাজ শেষ করতে ২০১২ সালে অনুমোদন করা বিআরটি প্রকল্পের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন ও ডিজাইন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা যেন অন্তহীন। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এখন ঝুলে যাওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাছে আরও এক বছর বাড়তি সময় চাইছে ।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পেলে পঞ্চমবারের মতো বাড়বে প্রকল্পটির মেয়াদ। আর এর কাজ শেষ হবে আগামী বছরের ডিসেম্বরে। ফলে সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে প্রকল্প প্রণয়ন, ডিজাইনসহ অগণিত কারণে চার বছরের প্রকল্প সম্পন্নে এখন এগারো বছর লাগবে।
প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাবের ওপর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বারবার প্রকল্পটির সময়সীমা বৃদ্ধির প্রস্তাবে অষন্তোষ প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। একই সঙ্গে প্রকল্পের ডিজাইন ও কাজে অবহেলায় জড়িতদের বিষয়ে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে।
আগেরবারের সংশোধনীতে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় টঙ্গী সেতুর প্রস্থ্যে পরিবর্তন, বিআরটির প্রতিটি স্টেশনে আন্ডারপাসের পরিবর্তে সমান্তরালে নির্মিত স্টেশনে ওভারপাস নির্মাণ, ছয়টি ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন, বিমানবন্দর এলাকায় ৫০০ মিটার আন্ডারপাস নির্মাণ, সমান্তরাল সড়ক কমিয়ে উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য ১ কিলোমিটার বৃদ্ধি এবং নতুন করে সার্ভিস লেন ও ফুটপাত নির্মাণের পরিকল্পনা করে।
কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের ডিজাইনে এত বেশি পরিবর্তনের নজির বাংলাদেশ, এমনকি বিশ্বের কোথাও নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, এমন প্রকল্পে এক যুগের বেশি সময় অতিবাহিত করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, গাজীপুরের মতো শ্রমঘন শিল্প এলাকায় পৃথক ফুটপাত নির্মাণ না করেই বিআরটি করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নয়নেরও পরিকল্পনা ছিল না।
শুরুতে এসব বিষয়ে নজর না দিয়ে পরে যোগ-বিয়োগ করায় প্রকল্পের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শামসুল হক বলেন, বৈশ্বিক আদর্শ মানের চাইতে চলমান বিআরটি প্রকল্পের ব্যয় অন্তত ১০গুণ বেশি। এর ফলে প্রকল্পটি আর লাভজনক থাকবে না বলেও তার ধারণা।
গতকাল বৃহস্পতিবার পিইসি সভায় সভাপতিত্বকারী পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, বৈঠকে কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদনের সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪০
আপনার মতামত জানানঃ