শিগগিরই সীমিত আকারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সরকারের দেয়া ভর্তুকি ও জ্বালানি পণ্যের বৈশ্বিক বাজারদর বিবেচনায় তা সীমিত আকারে বাড়ানো হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বিইআরসির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র।
এর আগে গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যহার বৃদ্ধি নিয়ে বিইআরসির সর্বশেষ গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিন মাসের বেশি সময় পেরোলেও এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা আসেনি। এ বিষয়ে বিইআরসির বক্তব্য হলো বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণের সঙ্গে ভর্তুকির বিষয়টি জড়িত। সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুতে চলতি অর্থবছরে প্রদেয় ভর্তুকির পরিমাণ জানানো হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে।
এর আগে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য না পাওয়ায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত কোনো ঘোষণা দিতে পারেনি বিইআরসি। যদিও আইন অনুযায়ী গণশুনানির ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মূল্যসংক্রান্ত বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে সংস্থাটির হাতে আর খুব বেশি সময় নেই।
দেশে গত এক যুগে নয়বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এ সময়ে পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দাম বাড়ানো হয়। ওই সময় সরকারি ভর্তুকি ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরে পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিইআরসিতে প্রস্তাব দিয়েছিল বিপিডিবি। ওই প্রস্তাবের ওপর কমিশনের গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয় গত ১৮ মে। সে সময়ে সংস্থাটি বিদ্যুতের দাম ৬৯ শতাংশ বাড়িয়ে ইউনিটপ্রতি ৮ টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব করে। এছাড়া গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বাড়লে ইউনিটপ্রতি ৯ টাকা ১৪ পয়সা এবং ১২৫ শতাংশ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৯ টাকা ২৭ পয়সা প্রস্তাব করে সংস্থাটি।
বিপিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে সংস্থাটির সরবরাহকৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৫ টাকা ১৭ পয়সা। গণশুনানিতে দাম বাড়ার বিষয়ে বিপিডিবির পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংস্থাটির ইউনিটপ্রতি খরচ হচ্ছে ৯ টাকারও বেশি। এতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিডিবির লোকসান হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি বিদ্যুতের বর্তমান দর ইউনিটপ্রতি ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৮ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়। এর বিপরীতে বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি বিদ্যুতের মূল্য ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে। এ সুপারিশ গৃহীত হলে বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি মূল্য বাড়তে পারে ২ টাকা ৯৯ পয়সা।
তবে সরকার এখন বিদ্যুতের দামের বিষয়টি নিয়ে কিছুটা ধীরগতি অবলম্বন করতে চাইছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সরকার চাচ্ছে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে যতদিন চলা যায়। যে কারণে বিইআরসিও দাম বাড়ার ঘোষণার বিষয়ে কিছুটা নমনীয় অবস্থান ধরে রেখেছে।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিইআরসির দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ফার্নেস অয়েলের আমদানি শুল্ক চালু, কয়লার ওপর ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর এবং দেশে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছুটা হলেও দাম বাড়বে। তবে কমিশন সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং জনদুর্ভোগের বিষয়টি মাথায় রেখে মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে বিদ্যুতের দাম ঠিক কত শতাংশ বাড়তে পারে সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি কেউই।
কমিশন-সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্রে জানা গিয়েছে, পাইকারিতে বিদ্যুতের মূল্য বিপিডিবির প্রস্তাবিত হারের পরিবর্তে ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে। গণশুনানিতে বিইআরসি কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে গড়ে প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল। এক্ষেত্রে মূলত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।
গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর বিদ্যুতের দাম বাড়ার বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে সরকার কিছুটা নমনীয় অবস্থান নিয়েছে। এরই মধ্যে তার আভাসও পাওয়া গেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। গত ২৪ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, এখনই সরকারের পক্ষে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো সম্ভব হবে না।
সরকারের এমন মনোভাবের কারণ সম্পর্কে জ্বালানি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ৬ আগস্ট দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। এ অবস্থার মধ্যে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার বাড়িয়ে দ্রুতই জনসাধারণকে আরেক দফা ভোগান্তিতে ফেলতে চায় না সরকার।
বিদ্যুতের মূল্যহার ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বিইআরসি সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এটি নিয়ে আমরা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে কাজ করছি। ভর্তুকির তথ্যের জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত চিঠিও পেয়েছি। আশা করছি দ্রুত যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে নতুন মূল্যহার ঘোষণার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম ভোক্তার জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার ওপরই প্রাধান্য দিচ্ছি আমরা।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ