সংবিধান, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও দেশে থেমে নেই হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) আসকের এক প্রতিবেদনে এতথ্য জানানো হয়েছে।
আসকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সাত মাসে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের আগেই ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে দুই জন। গ্রেপ্তার দেখানোর আগে শারীরিক নির্যাতনে র্যাবের হেফাজতে এক জন ও পুলিশের হাতে দুই জন, গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনে পুলিশের হেফাজতে তিন জন নিহত হয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ মাসে র্যাবের হেফাজতে হার্ট অ্যাটাকে এক জন, পুলিশের হেফাজতে অসুস্থতায় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।
আসক জানায়, প্রতিবেদনটি প্রস্তুতের জন্য তারা দৈনিক প্রথম আলো, ইত্তেফাক, সমকালসহ বেশ কয়েকটি বাংলা, ইংরেজি দৈনিক এবং নিউজপোর্টাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
এই সাত মাসে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের আগেই ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে দুই জন। গ্রেপ্তার দেখানোর আগে শারীরিক নির্যাতনে র্যাবের হেফাজতে এক জন ও পুলিশের হাতে দুই জন, গ্রেপ্তারের পর শারীরিক নির্যাতনে পুলিশের হেফাজতে তিন জন নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (৩১ অনুচ্ছেদ)। নবম সংসদে পাস করা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩ ’-এ সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
২০০৩ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে এই নিয়ে সুস্পষ্ট বাধার কথা বলা হয়েছিল, ১৩ বছর লেগেছিল এই বিষয়ে সরকারের আপিল নিষ্পত্তি করতে, ২০১৬ সালের মে মাসে সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল, ১০ নভেম্বরে পূর্ণ রায় প্রকাশিত হয়, সেখানে ১৬৪ ধারার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনায় সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে সরকারের হেফাজতে থাকার সময় কারও ওপর নির্যাতন করা যাবে না।
বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বেআইনি কাজ, অপরাধ। তারপরও এর বিচার হয় না। ২০১৩ সালের আইনে এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে একটি।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগও করে না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেওয়ার উদাহরণ বিরল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু অভিযোগ না করেও পরিবারের যেসব অভিজ্ঞতা তা জানলেই বোঝা যায়, কেন কারও পক্ষে অভিযোগ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজে হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই ধরনের মানসিকতাই যে সহযোগী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কাজে পরোক্ষ ভূমিকা পালনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও যে পিছিয়ে নেই, তা এই প্রতিষ্ঠানের নির্লিপ্ততাতেই স্পষ্ট। কমিশন একবার বলেছিল যে বেছে বেছে কয়েকটা ঘটনার তদন্ত করবে, সেই কথা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কমিশনের জবাবদিহির অভাব পুলিশ এবং সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
তারা বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে পুলিশ নিজেরাই তদন্ত করে, ফল যা হওয়ার তা-ই হয়, যে পুলিশ মামলাই নিতে চায় না, তার হাতে তদন্তের ভার দিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হওয়ার কারণ নেই। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য কোনো স্বাধীন কমিশন গঠনের ইচ্ছা বা আগ্রহ যে সরকারের নেই, তা-ও সহজেই বোধগম্য।
আরও বলেন, পুলিশের কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করেছেন, যেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল করে দেওয়া হয়। এই দাবি একেবারে নাকচ করে দেওয়া হয়েছে এমন নয়। তদুপরি, পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, তাতে এই বাহিনীর সদস্যরা যে নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বেই ভাববেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই; হেফাজতে মৃত্যু, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা সেগুলো প্রতিদিন প্রমাণ করে দিচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০০৬
আপনার মতামত জানানঃ