সম্প্রতি ব্ল্যাক ডেথ নামে পরিচিত প্লেগ রোগের উৎপত্তিস্থল আবিষ্কার করা গেছে বলে বিশ্বাস করছেন গবেষকরা। ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় রোগটির কারণে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে কয়েক’শো বছরে। ছয়শত বছর পর এই তথ্য জানতে পারার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা।
মূলত প্লেগকে বলা হয় ব্ল্যাক ডেথ। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে একে অভিহিত করা হয়। বছরের পর বছর গবেষণা চালিয়েও বিজ্ঞানীরা প্লেগের উৎপত্তি কোথায় তা জানতে পারেননি। এই বিষয়টি নিয়ে তারা নিজদের মধ্যে কম কানাঘুষা করেননি। ইউরোপিয়ানরা বরাবরই বলে আসছিল এর জন্য তাদের দায়ী করা একেবারেই ভুল। তবে গত ৮০০ বছরে ছড়ানো মহামারির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ইউরোপ থেকেই এটি সর্বত্র ছড়িয়েছে। পশ্চিম ইউরোপে প্লেগের তাণ্ডব শুরু হয় ১৩৪৬ সালে। এরপর ইংল্যান্ডে এর প্রকোপ শুরু হয় ১৩৪৮ সালে। ১৩৫০ এর দশকের শুরুর দিকে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে চলা ভয়াবহ প্লেগ মহামারিতে ইউরোপের প্রায় ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ জনগণ মারা যায়।
সম্প্রতি এক গবেষক দল কিরগিজস্তানের ইসিক কুল লেকের পাশাপাশি একটি কবরস্থান থেকে সংগ্রহ করা কংকালের ডিএনএ নমুনা বিশ্লেষণ করে এই রোগের অরিজিন বা উৎপত্তিস্থল আবিষ্কারের দাবি করেছেন। ১৩৩৮ এবং ১৩৩৯ সালে সেখানে দাফনের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় তারা গবেষণার জন্য ওই স্থানটি বেছে নেন। এই গবেষণায় স্কটল্যান্ডের স্টারলিং ইউনিভার্সিটি, জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট এবং ইউনিভার্সিটি অব তুবিনজেন এর একদল গবেষক অংশ নেন।
স্টারলিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ ড. ফিলিপ স্লাভিন যুগান্তকারী এই আবিষ্কার সম্পর্কে বলেন, ‘আমাদের গবেষণা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটির অবসান ঘটিয়েছে। মানবসভ্যতায় সবচেয়ে কুখ্যাত এবং ভয়ংকর রোগ কীভাবে শুরু হয়েছিল তা নির্ধারণ করেছে।’
এই মহামারীর উৎস নিয়ে ইতিহাসবিদরা কয়েক শতাব্দী ধরে গবেষণা করছিলেন। এই গবেষণার অংশ হিসেবে গবেষকরা ১৮৮০ এর দশকে প্রথমবারের মতো কিছু পুরাতন কবর খনন করেন। ওই সমাধিতে থাকা খোদাই করা পাথরের শিলালিপিগুলোর ভাষা ২০১৭ সালে স্কটিশ অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ফিল স্লাভিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বের করেন।
তিনি শিলালিপিগুলো বিশ্লেষণ করে জানতে পারেন সেখানে মাত্র দুই বছরের মধ্যে ৪৬৭টি মৃতদেহ দাফন করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যখন আপনার অতিরিক্ত মৃত্যুহারের সাথে এক বা দুই বছরের মধ্যে ঘটে তখন বুঝতে হবে যে কিছু একটা ঘটছিল। কিন্তু আরেকটি জিনিস যা সত্যিই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হচ্ছে যে এটি কোনো বছর ছিল না। কারণ এটি ঘটেছিল মাত্র সাত বা আট বছর আগে যখন প্লেগ প্রথমবার ইউরোপে এসেছিল।
স্লাভিন এবং তার সহযোগীরা আবিষ্কার করেন যে, কিরগিজস্তানের ওই কবরে সমাধিস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০ জনের দেহাবশেষ রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে পিটার দ্য গ্রেট মিউজিয়াম অফ নৃবিজ্ঞান এবং নৃতাত্ত্বিকতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওই সূত্র ধরে, দেহাবশেষগুলোর ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণের অনুমতি চায় তারা। সৌভাগ্যক্রমে তারা অনুমতি পান। সাতটি দেহের দাঁত থেকে নমুনা নেন গবেষকরা। সেখানকার জেনেটিক উপাদানে তারা প্লেগ ব্যাকটেরিয়ামের ডিএনএ খুঁজে পান। ওই সাতজনের মধ্যে তিনজনকে সমাধিস্থ করা হয় ১৩৩৮ সালে। ওই ডিএনএ’র মাধ্যমে সে সময়ের প্লেগের কারণ আংশিকভাবে জানা যায়। ওই গবেষকের দল জানিয়েছেন, তখন ইঁদুর ও মাছিদের মাধ্যমে মানুষের
১৩৪৭ সালে প্রথমবারের মতো এই রোগটি কৃষ্ণ সাগরের আশেপাশের অঞ্চল থেকে পণ্য পরিবহনকারী বাণিজ্য জাহাজের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করে। নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুসারে ভূমধ্যসাগরের মাধ্যমে রোগটি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখিত দেশগুলোতে তৎকালীন জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়। যাইহোক, বিগত বছরগুলোতে পশ্চিমারা ব্ল্যাক ডেথের জন্য চীন, ভারত ও কাস্পিয়ান সাগরের পাশের দেশগুলোকে দায়ী করতো। এখন তারাই সন্দেহের তীর মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তান তথা মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাক করেছে।
সম্প্রতি গবেষণায় বোঝা যায়, মানুষের ডিএনএ-তে প্লেগ একটি বিশেষ জেনেটিক ছাপ ফেলে যা আমাদেরকে রোগটি নিয়ে অনেক তথ্য সরবরাহ করে। ২০১১ সালে লন্ডনের একটি সমাধি থেকে দুই ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা করে এই রোগের জন্য দায়ী ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস নামক ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া যায়। এই ঘটনার পর থেকে ইউরোপ এবং রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের একাধিক কবরস্থান থেকে আরও জেনেটিক উপাদান পুনরুদ্ধার করা হয়। এসব থেকেই বিজ্ঞানীরা প্লেগ স্ট্রেইনের বৈচিত্র্য বুঝতে পারেন।
ওই বৈচিত্রের আলোকে সাম্প্রতিক গবেষণায় যুক্ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, কিরগিজস্তানের ইসিক-কুল হ্রদের কাছে দুটি কবরস্থানের আশেপাশের এলাকাটি অবশ্যই প্লেগ স্ট্রেইনের উৎস যা ব্ল্যাক ডেথের উৎপত্তিস্থল। আর এই বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য দুটি প্রাচীন প্লেগের জিনোম দাঁতের নমুনা মেলানো হয়। জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ টুবিনজেনের পোস্টডক্টরাল গবেষক মারিয়া স্পাইরো বলেছেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি যে কিরগিজস্তানের প্রাচীন স্ট্রেইনগুলো এই বিশাল বৈচিত্র্যের ইভেন্টের নোডের ঠিক অবস্থানে রয়েছে।
গবেষণার পেছনে আরও বিশ্বস্ত প্রমাণ দাঁড় করিয়েছেন এর সঙ্গে যুক্তরা। বর্তমান সময়ে ইঁদুরের মধ্যে পাওয়া প্লেগ স্ট্রেইনের সাথে বিভিন্ন কবরস্থান থেকে ক্রমানুসারে পাওয়া প্লেগের স্ট্রেইনের তুলনা করেন গবেষকরা। এই পর্যায়ে তারা দেখতে পেয়েছে যে, আধুনিক প্লেগ স্ট্রেইনগুলো প্রাচীন স্ট্রেইনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। তিয়ান শান পর্বতের ইঁদুরের দেহে পাওয়া স্ট্রেইনের সঙ্গে দুটি সমাধিস্থলের ডিএনএ’র ব্যাপক মিল রয়েছে।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজির ডিরেক্টর ও গবেষণাক জোহানেস ক্রাউস বলেন, ‘আসলে যেটা উল্লেখযোগ্য তা হলো, আজ ওই অঞ্চলে বসবাসকারী ইঁদুরদের মধ্যে আমাদের ওই প্লেগ ব্যাকটেরিয়ার নিকটতম জীবিত আত্মীয় রয়েছে। আমরা কেবল ব্ল্যাক ডেথের পূর্বপুরুষদের খুঁজে পাইনি, তবে আমরা আসলেই বেশিরভাগ প্লেগের স্ট্রেইনের পূর্বপুরুষকে খুঁজে পেয়েছি যা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।’
তবে এই কথা নিশ্চিত যে তারা এই রোগের প্রকৃত উৎস এখনও খুঁজে পায়নি। বরং তারা এখন পর্যন্ত চলমান গবেষণার সর্বোচ্চ ফলাফল পেয়েছেন। শুধু এই গবেষণা দিয়ে কিরগিজস্তান তথা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোকে দায়ী করা অনুচিত হবে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ৩ হাজার ২৪৮ জনের এই রোগে আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যায়। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮৪ জনের মৃত্যু হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২৫
আপনার মতামত জানানঃ