সৌদি আরবের মক্কা থেকে মদিনা পর্যন্ত চলা হারামাইন হাইস্পিড ট্রেন চালাতে যাচ্ছেন দেশটির ২১ জন নারী। ট্রেন চালানোর প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপ তাত্ত্বিকভাবে শেখার পর এখন তাদের চালক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সূত্র- সৌদি গেজেট
মূলত পাঁচ থেকে ছয় মাস প্রথম ধাপের প্রশিক্ষণের পর দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে তাদের বাস্তবে ট্রেন চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম ধাপে নারীরা ৪৮৩ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল রেলপথের সাধারণ জ্ঞান, ট্রাফিক ও নিরাপত্ত নিয়ন্ত্রণ, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ, অগ্নি নিরাপত্তা, ট্রেন ও রেলপথের অবকাঠামোর টেকনিক্যাল ধারণা।
হারামাইন স্পিড ট্রেনের সবচেয়ে বড় সহযোগী ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান স্পেনের রেনফি এবং সৌদি রেলওয়ে পলিটেকনিক গত নয় বছর ধরে ট্রেন চালানোর জন্য ১৩০ সৌদিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
এর আগে, রেনফি ৩০ জন সৌদি নারীকে ট্রেন চালক হিসেবে নিয়োগ দিতে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিল। এতে সৌদি আরব থেকে বেশ সাড়া পায় প্রতিষ্ঠানটি। ঐ বিজ্ঞাপনের সাড়া দিয়ে ২৮ হাজার নারী ট্রেন চালক হতে আবেদন করেন। সেখান তেকে ১৪৫ জনকে বাছাই করা হয়। তাদের মধ্যে থেকে সাক্ষাৎকার শেষে ৩৪ জনকে প্রথম ধাপের জন্য নির্বাচন করা হয়।
৩৪ প্রশিক্ষকের মধ্যে ৩১ জন তাত্ত্বিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন যাদের ৭০ শতাংশের বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি রয়েছে। চলতি নিয়োগে মাত্রা ৩০ শতাংশ সৌদি পুরুষ শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিচ্ছেন।
আশা করা হচ্ছে যে, সব পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ শেষে উত্তীর্ণরা চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে সৌদির বিভিন্ন শহরগুলোতে ট্রেন চালাতে পারবেন।
এদিকে, পরবর্তী ধাপে ট্রেন চালক হিসেবে নারী ও পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। কারণ দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে হজ ও ওমরাহ মৌসুমে এর চাহিদা বেশি থাকে।
সৌদি নারীদের ওপর থেকে গাড়ি চালানোর নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছে, যা ২০১৮ সালের জুন থেকে কার্যকর হয়। তাই, সে দেশের নারীদের গাড়ি চালানোতে আর কোনো বাধা না থাকায় এখন থেকে নারীরা হতে পারছেন উবার ড্রাইভার। বছর কয়েক আগেও উবারের সব ড্রাইভারই ছিল পুরুষ। এখন দেশটিতে পুরুষের পাশাপাশি বাড়ছে নারী উবার চালকও।
২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দেওয়ার পর থেকে সৌদিতে পরিবহণ খাতে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিমান বা ট্রেন চালনা থেকে ধরে রেইস কার চালনার ক্ষেত্রেও নারীরা এখন ক্যারিয়ার গড়তে পারবেন। নতুন নিয়মের আওতায় নারীরা উবার বা কেয়ারিম-এর মতো রাইড অ্যাপগুলোতেও ড্রাইভার হিসেবে যোগ দিতে পারবেন।
আশা করা হচ্ছে যে, সব পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ শেষে উত্তীর্ণরা চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে সৌদির বিভিন্ন শহরগুলোতে ট্রেন চালাতে পারবেন।
অতীতে সৌদিতে নারীদের খেলাধুলা অনৈতিক কাজের অংশ হিসেবে দেখতো রক্ষণশীলরা। এখন সময় বদলেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সৌদির নারীরাও রাজপথে সাইকেল চালাতে পারছেন। আর জেদ্দা শহরে এই দৃশ্য এখন স্বাভাবিক।
সব প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সৌদির নারীরাও এগিয়ে চলছেন। বর্তমানে সৌদি আরবের নারীদের সাইকেল চালানোর ঘটনা চোখে পড়ার মতো। সৌদির কঠিন শাসন উপেক্ষা করেই এই দুই চাকার বাহন নিয়ে ছুটে চলছেন নারীরা।
সৌদি আরবে গত কয়েকবছর ধরে নারী অধিকারসহ নানা বিষয়ে সংস্কারকাজ চলছে৷ ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মেদ বিন সালমানের সংস্কার কর্মসূচি ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সৌদি নারীরা বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন৷ গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে সৌদি নারীরা পুরুষ সঙ্গীর অনুমতি ছাড়াই ব্যবসা শুরু করতে পারছেন৷ কর্মক্ষেত্রে সৌদি নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোরও পরিকল্পনা করা হয়েছে৷ ২০৩০ সালের মধ্যে মোট জনশক্তির এক তৃতীয়াংশ নারী করতে চায় দেশটি৷ এ সব ছাড়াও সম্প্রতি প্রথম নারী রেস্তোরাঁ মালিক, প্রথম নারী পশু চিকিৎসক, প্রথম নারী ট্যুর গাইড পেয়েছে সৌদি আরব৷
২০১৭ সালের পর সৌদির পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। যুবরাজ সালমান দেশটির সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনায় আগের চেয়ে স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে পারছেন নারীরা। ২০১৭ সালের আগে সৌদিতে নারীদের সাইকেল চালানোর কথা যেখানে ভাবাই যেতো না।
২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয় দেশটি। ফলে গাড়ি চালাতে সৌদি নারীদের আর কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে না। এছাড়া গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাচ্ছেন তারা।
ওজন ও উচ্চতার শর্ত পূরণ করে নারীরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে। তবে অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করা লাগবে তাদের।
২০২০ সালে সৌদি আইন মন্ত্রণালয় ১০০ নারীকে পাবলিক নোটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়। চলতি বছর জানুয়ারিতে ঘোষণা দেওয়া হয়, শিগগিরই আদালতে নারী বিচারকও নিয়োগ দেওয়া হবে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো নারী বিমানবালা নিয়োগ দেয় সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস। দেশটিতে নারী যাত্রীদের সেবার জন্য ৫০ জন বিমানবালা নিয়োগ করা হয়।
সৌদি আরবকে আরও আধুনিক, উদার এবং ব্যবসা ও পর্যটনবান্ধব করতে ২০১৬ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছিলেন ক্রাউন প্রিন্স মোহামেদ বিন সালমান৷ এরপর বেশ কিছু আইনে পরিবর্তন করা হয়৷ ফলে সেদেশের নারীরা এখন গাড়ি চালানো, একা সিনেমা হলে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়াসহ নানান কাজ করতে পারছেন৷
সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোও ভিশন ২০৩০ এর অংশ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে৷ এমনও কথা শোনা যাচ্ছে, সেখানে অ্যালকোহল পান বিষয়ে সীমিত পরিসরে হলেও অনুমোদন দেয়া হতে পারে৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কট্টর রক্ষণশীল দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব দেরি হলেও নিজেদের বুঝতে পারার চেষ্টা করছে। উবার চালানো, সাইকেল চালানো, ট্রেন চালানো সৌদি নারীদের জন্য যুগান্তকারী এক ব্যাপার বটে। বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন নারীদের মতো সৌদি আরবের নারীরাও নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাবেন এমন প্রত্যাশা লক্ষণীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৭
আপনার মতামত জানানঃ