রাজনৈতিকভাবে বহুদিন ধরেই প্রতিকূল পরিবেশের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের শক্ত অবস্থানের কাছে রীতিমতো অসহায় অবস্থায় রয়েছে দলটি। মূলধারার রাজনৈতিক দলটি দীর্ঘদিন এ অবস্থায় থাকার কারণে সাংগঠনিকভাবেও হারিয়েছে শক্তি।
অবশ্য সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম ও বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে আসছে বলেও দাবি করছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, সেই ধারাবাহিকতায় আগামীতে আরও গতিশীল কর্মসূচি দেওয়া হবে।
যদিও ভোলায় পুলিশের হামলায় দুই নেতা নিহত হওয়ার পরও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেই আছেন তারা। তৃণমূল থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের চাপ থাকা সত্ত্বেও আপাতত কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি।
বিদ্যুৎ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবিতে সম্প্রতি ভোলা জেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। সেখানে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় গুলিতে আবদুর রহিম নিহত হন। সংঘর্ষে আহত হন দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। বিএনপির দাবি, আবদুর রহিম ভোলা সদর উপজেলার দিঘলদী ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব ছিলেন।
এ ঘটনায় ঘোষণা করা হয়েছে শোক ও বিক্ষোভ কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে যাতে বিশৃঙ্খলা বা সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে অতীতে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া সরকার বা বিভিন্ন শক্তির প্রলোভনে পড়ে হটকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যার নেতিবাচক ফল আমরা পেয়েছি। কিন্তু এবার খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চূড়ান্ত আন্দোলনে অনেকটাই ধীরে চলো নীতিতে দলের হাইকমান্ড।
তাদের মতে, ভোলায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের হামলা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সেখানে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি যার জন্য এভাবে গুলি চালাতে হবে। একটি পরিস্থিতি তৈরি করে বিএনপিকে এখনই রাজপথে নামানোর কৌশল হতে পারে। তাই আমরাও এবার সে ফাঁদে পা দেব না। আপাতত ইস্যুভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি, দল গোছানো আর বৃহত্তর ঐক্যেই গুরুত্ব দেওয়া হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতীয় দৈনিক যুগান্তরকে বলেন, অনেকে জানতে চান কবে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। তাদের কথা শুনে আমি অবাক হই। বিএনপি তো আন্দোলনের মধ্যেই আছে। সরকারের নানা ব্যর্থতায় আমরা রাজপথেই প্রতিবাদ করছি। আন্দোলন মানে তো গাড়ি ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও নয়। আমরা এসবে বিশ্বাস করি না। জনগণও সেটা চায় না। আমরা চাই সরকারবিরোধী একটি গণআন্দোলন। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। বৃহত্তর ঐক্য তৈরিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছি। গণঅভ্যুত্থান ছাড়া এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটানো সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, বিএনপির সব সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। কিন্তু সরকার তার গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করে সব সময় বিএনপির ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। অতীতে আমরা সরকারের এমন নীলনকশা দেখেছি। সরকার একটা বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি করে বিএনপিকে আন্দোলনে উসকে দিতে চাইছে। কিন্তু আমরা সরকারের কোনো উসকানিতে পা দেব না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সময়মতো চূড়ান্ত আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
যেকোনোভাবে এই মুহূর্তে বিএনপিকে রাজপথে নামাতে চায় সরকার। এমন বার্তা তাদের কাছে রয়েছে।
জানা গেছে, ভোলায় পুলিশি হামলার পরপরই দলের নীতিনির্ধারকরা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। পুরো পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণ করেন তারা। বৈঠকে প্রায় সব নেতাই একমত হন, এ ঘটনার পেছনে সরকারের কোনো পরিকল্পনা রয়েছে।
তারা মনে করেন, এর পেছনে সরকারের মূলত দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এক, যেকোনোভাবে এই মুহূর্তে বিএনপিকে রাজপথে নামাতে চায় সরকার। এমন বার্তা তাদের কাছে রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, রাজপথে নামলে সরকার কতটা কঠিন হতে পারে বিরোধী দলগুলোকে এমন বার্তা দেওয়া। তবে সরকার যে কৌশলই নিক আমাদের ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ মুহূর্তে ইস্যুভিত্তিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী জনমত তৈরির দিকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে নেতারা মত দেন। তারা জানান, কঠোর কর্মসূচি দিলেই সংঘাত ও সহিংসতা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
এতে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা নতুন করে মামলা-হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর বাকি। নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে এত আগে মাঠে নামলে ফল নিয়ে ঘরে ফেরা কঠিন হবে। আন্দোলনের ফল এবার যাতে ঘরে আনা যায় সেই কৌশলেই এগোতে হবে।
দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান-দুর্নীতি, অনিয়ম আর সবশেষ ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক। দ্রব্যমূলের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিংয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। জনগণ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। জন ক্ষোভকে ভিন্ন খাতে নিতে সরকার নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। বিএনপিকে রাজপথে নামিয়ে তাদের ব্যর্থতার দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। কিন্তু বিএনপি সে পথে পা বাড়াবে না। তাছাড়া দেশের এমন পরিস্থিতিতে হরতাল, অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হলে জনদুর্ভোগ আরও বাড়বে। জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করেও এই মুহূর্তে কঠোর আন্দোলনে না যাওয়ার পক্ষে হাইকমান্ড।
এদিকে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের স্লোগান তুলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ ‘সুবিধা’ পেয়ে আসা বিএনপির সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না!
কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে বিএনপির দূরত্ব। ফলে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া সমর্থন ও সহযোগিতা দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বিএনপির জন্য।
বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসবে না ধর্মভিত্তিক দলগুলো। আসছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে সরকারবিরোধী সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে বিএনপি। প্রথম পর্যায়ে ১৪টি দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছে বিএনপি। পর্যায় ক্রমে আরো বাকি দলগুলোর সাথে বসবেও তারা।
তবে বিএনপির এই আলোচনায় যোগ নিতে আগ্রহী নয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো। এসব দলের নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনের এখনও দেড় বছরের বেশি সময় বাকি আছে। এই মুহূর্তে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপে বা মতবিনিময়ে অংশ নিলে নানামুখী ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। তাছাড়া অন্য কোনো দল বা জোটে না গিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতায় আসা যায় কি না তা নিয়েও আলোচনা চলছে দলগুলোর মধ্যে।
ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, গত বছর হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তাদের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যারা এখনো মুক্তি পাননি। সরকারের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক করেও তাদের মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। এখন যদি সরকারের প্রতিপক্ষ বিএনপির সঙ্গে নতুন করে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাহলে দমন-পীড়ন আরও বাড়তে পারে।
এ কারণে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো সংলাপে অংশ না নেওয়ার একরকম নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে এসব দল। যদিও ধর্মভিত্তিক এসব দলকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো সংলাপের আমন্ত্রণ জানায়নি বিএনপি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৫৭
আপনার মতামত জানানঃ