মহাসড়ক এখন এক আতঙ্কের নাম। যানবাহনে ডাকাতি এখন প্রায় প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর অধিকাংশ ঘটনায়ই কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। যানবাহনে কয়েক ঘন্টা ধরে ডাকাতি, ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও হাইওয়ে পুলিশের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।
গত সাত মাসে অন্তত ২৫টি বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বাসে। আর গত তিন মাসে পুলিশের ৯৯৯-এ যানবাহনে ডাকাতিসহ নানা অঘটনের ঘটনায় কল এসেছে ২৪৮টি।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাড়কে মধুপুর “ঈগল পরিবহনে” ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার পর এখন গা শিউরে ওঠা বর্ণনা দিচ্ছেন আহতরা। শিশুদেরও রেহাই দেয়নি ডাকাতেরা। তারা যাত্রী বেশে কয়েক পর্যায়ে বাসে ওঠার পর ডাকাতি শুরুর আগে সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নয়। ফলে যাত্রীরা ৯৯৯ নম্বারেও ফোন করতে পারেননি। তারা বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের ইচ্ছেমত গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন করে তিন ঘন্টা ধরে ডাকাতি ও ধর্ষণ করে। কিন্তু এই সময়ে কোনো হাইওয়ে পুলিশ বা তাদের টহল গাড়ি ওই এলাকায় দেখা যায়নি। ডাকাত দল ডাকাতি শেষে মাইক্রোবাসে করে পালিয়ে যায়। হাইওয়ে পুলিশ দাবি করেছে তারা অন্য একটি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
গত ১৩ বছরে ওই এলাকায় চলন্ত বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতির সময় দুই নারীকে হত্যা ও চারজনকে ধর্ষণের রেকর্ড আছে পুলিশের কাছে। ২০০৯ সালে বাস ডাকাতেরা টাঙ্গাইলের মহাসড়কে ডাকাতি করতে গিয়ে বাসন্তী মাংসাং নামে এক স্কুল শিক্ষিকাকে হত্যা করে। ২০১৬ সালে টঙ্গাইলের ধনবাড়ি এলাকায় “বিনিময় পরিবহনে” বাস ডাকাতেরা এক নারীকে ধর্ষণ করে। ২০১৭ সালে ওই মহাসড়কেই বাসে জাকিয়া সুলতানা রূপা নামে এক যাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ওই মহাসড়কে বাসে আরো তিনজন নারী বিভিন্ন সময় বাস ডাকাতদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন।
বেপরোয়া ডাকাত বনাম পুলিশের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা
গত ১১ জুন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (ব়্যাব) ঢাকার আশুলিয়া এলাকা থেকে বাসে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ একটি চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তারা ১১মে আশুলিয়ায় হানিফ পরিবহন, ২৫ মে রাজশাহীতে ন্যাশনাল ট্রাভেলস এবং ২৯ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে ষ্টার লাইন পরিবহনে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। শুধু তাই নয়, গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার স্বীকার করে যে গত দেড় বছরে অন্তত ১৫ টি ডাকাতি করেছে মহাসড়কের বাসে।
ডাকাত দল আরো জানিয়েছে তারা চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কে সৌদিয়া বাসে ডাকাতির সময় বাসচালকের হাতে ও হেলপারের পেটে ছুরিকাঘাত করে। এছাড়া তারা ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফাল্গুনি ট্রাভেলস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও কণক পরিবহন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে সুরভী পরিবহন, হানিফ পরিবহন, সিলেট-রাজশাহী মহাসড়কে শ্যামলী পরিবহন ও রইস পরিবহন, ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে পাবনা এক্সপ্রেস ও সরকার ট্রাভেলস, রাজশাহী-বরিশাল মহাসড়কে সেবা গ্রীণলাইন পরিবহন ও তুহিন পরিবহনে ডাকাতি করেছে বিভিন্ন সময়ে। এই চক্রটি কমপক্ষে ১৫ বছরে ধরে মহাসড়কে ডাকাতি করে আসছে। এই ডাকাতির সময় তারা একাধিক ধর্ষণের কথাও স্বীকার করেছে৷
হাইওয়ে পুলিশের কাছে মহাসড়কে ডাকাতির কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে মহাসড়কে বাস ডাকাতির বেশ কিছু খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যায় গত সাত মাসে অন্তত ২৫টি বড় ধরনের ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে বাসে। আর গত তিন মাসে পুলিশের ৯৯৯-এ যানবাহনে ডাকাতিসহ নানা অঘটনের ঘটনায় কল এসেছে ২৪৮টি। গড়ে প্রতিদিন এই সংক্রান্ত কল আসে তিনটি।
সারাদেশে হাইওয়ে আছে ১১ হাজার ৮০৬ কিলোমিটার। ২০০৫ সাল থেকে মহাসড়কের নিরাপত্তায় কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। তাদের মোট জনবল আছে দুই হাজার ১৯২ জন। পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ হয়ে ভাগ করে তারা। প্রতিটি অঞ্চলের দায়িত্বে একজন করে পুলিশ সুপার।
হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর জোনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজমুস সাকিব খান বলেন, “আমাদের পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় অনেক জায়গায় টহল দেয়া সম্ভব হয় না।”
বাস কর্মচারী ও পুলিশের দায়
এদিকে বাসে ডাকাতির ঘটনা বিশ্লেষণে দেয়া যায় ডাকাত দল সড়কের মাঝখান থেকে যাত্রী সেজে বাসে ওঠে। মধুপুরে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় দেখা গেছে ডকাত দল তিন জায়গা থেকে যাত্রী হিসেবে ওঠে। কিন্তু দূরপাল্লার বাসে মাঝপথে যাত্রী ওঠানো নিষেধ। চালক ও সুপারভাইজাররা বাড়তি আয়ের জন্য এই কাজটি করেন। যার পরিণতি হয় ভয়বাহ। আবার দুই-একটি ঘটনায় বাসের চালক সুপারভাইজারদের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে পাওয়া গেছে তদন্তে।
দূরপাল্লার বাসে যাত্রীদের সবার ছবি ও ভিডিও যাত্রার শুরুতে তুলে রাখার নিয়ম থাকলেও তা এখন মানা হচ্ছে না। পুলিশেরও এই দায়িত্ব আছে। তারা যেকোনো স্পটে বাস থামিয়ে অন্তত একবার ছবি তুলবে ও ভিডিও করবে। কিন্তু মধুপুরের ঈগল পরিবহণের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। আর শুরুতে ছবি তোলা হলেও মাঝপথে যাত্রী ওঠালে তাদের ছবি থাকে না। ডাকাতেরা এই সুযোগ কাজে লাগায়।
হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারা সড়কে টহলের সময় তাদের নজর থাকে পণ্যবাহী ট্রাকের দিকে। চাঁদা আদায়ের জন্যই তারা ট্রাকের দিকে নজর রাখে। বাসের দিকে তাদের কোনে নজর থাকে না। ফলে ডাকাতির সময় হাইওয়ে পুলিশকে পাওয়া যায় না। মধুপুরে তিন ঘন্টা ধরে বাসে ডাকাতি হলেও কোনো হাইওয়ে পুলিশকে ওই এলাকায় টহলে দেখা যায়নি। এমনকী পরবর্তীতেও তাদের কোনো তৎপরতা ছিল না। যা করার স্থানীয় থানা পুলিশ করেছে।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতুল্ল্যাহ চালক ও সুপারভাইজারদের লোভের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “নিষিদ্ধ থাকার পরও তারা মাঝপথে যাত্রী তোলেন। আর অধিকাংশ ঘটনায়ই মাঝপথ থেকেই যাত্রীবেশে ডাকাত ওঠে। নিয়ম থাকলেও ছবি ও ভিডিও নেয় হয় না। পুলিশও এটা এখন আর করে না।”
তিনি বলেন, “মহাসড়কে ২০-২৫টি জায়গা আছে যেখানে নিয়মিত ডাকাতি হয়। ওইসব এলাকায় নিয়মিতভাবে হাইওয়ে পুলিশ টহল দিলেই ডাকাতি বন্ধ হবে। আমরা অনেক দিন ধরেই এটা বলে আসছি। হাইওয়ে পুলিশ ট্রাকের দিকেই বেশি নজর দেয় লাভের আশায়।”
কী বলছে পুলিশ?
হাইওয়ে পুলিশ কর্মকর্তা নজমুস সাকিব খান দাবি করেন, “বাসের ভিতরের লাইট বন্ধ থাকলে আমরা কিছু বুঝতে পারি না। আর অস্বাভাবিক কিছু না দেখলে আমরা গাড়ি থামাই না। বাইরে থেকে তো আর বোঝা যায় না।”
তিনি হাইওয়ে পুলিশের চাঁদাবজির দিকে মনোযোগের অভিযোগের কথা স্বীকার করে বলেন,”আমরাও অভিযোগ পাই। কিন্তু প্রমাণ না পেলে তো ব্যবস্থা নিতে পারি না।”
তিনি দাবি করেন, “মধুপুরে ঈগল পরিবহনের ডাকাতির কাছেই এলেঙ্গা এলাকায় টহল ছিল। তবে তারা একটি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।”
এসডব্লিউ/এসএস/২০৫০
আপনার মতামত জানানঃ