নামের সঙ্গে ‘প্রত্যাবর্তন’ শব্দটি জুড়ে গিয়েছিল তিন দশক আগেই। অবসর ভেঙে ২২ গজের লড়াইয়ে ফিরে পাকিস্তানকে জিতিয়েছিলেন বিশ্বকাপ। এ বার দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর তিন মাসের মাথায় ভোট-রাজনীতিতে ইমরান খানের চমকপ্রদ জয় সেই ‘কামব্যাক’-এর অতীতকে দিল নতুন মাত্রা।
পাক পঞ্জাব প্রদেশের আইনসভার ২০টি আসনের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে ১৫টিতেই জয় পেয়েছে ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। সেখানে পাকিস্তান এবং পাক পঞ্জাবের শাসকদল ‘পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ)’ বা পিএমএল(এন) জিতেছে মাত্র চারটিতে! একটিতে জিতেছেন নির্দল প্রার্থী।
এর ফলে পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশে ইমরানের দলের ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে। ঘটনাচক্রে, পঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে রয়েছেন বর্তমান পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের পুত্র হামজা। গত শুক্রবার পঞ্জাব অ্যাসেম্বলির অধিবেশন ডেকে তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের নির্দেশ দিয়েছে লাহৌর হাই কোর্ট। পঞ্জাবে ক্ষমতা দখল করতে পারলে পাক রাজনীতিতে ইমরানের প্রতিপত্তি ফের বাড়তে শুরু করবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
পিটিআইয়ের অন্দরে বিদ্রোহ, পিএমএল(এন), পাকিস্তান পিপলস পার্টি, মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের মতো বিরোধী দলগুলির নজিরবিহীন জোট এবং পাক সুপ্রিম কোর্টের ধারাবাহিক ভর্ৎসনায় বিদ্ধ ইমরান গত ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দেশ জোড়া তুমুল অর্থনৈতিক সঙ্কটের জেরে সে সময় তার জনসমর্থনও তলানিতে ঠেকেছিল। কিন্তু পঞ্জাব প্রদেশের সদ্যসমাপ্ত উপনির্বাচন ইঙ্গিত দিচ্ছে, ক্রিকেটের মতোই রাজনীতির ‘ঘূর্ণি পিচেও’ প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে ‘ক্যাপ্টেন’-এর।
প্রধানমন্ত্রিত্বের ‘ইনিংসের’ মাঝপথে ‘রান আউট’ হওয়ার সময় ইমরান জানিয়েছিলেন, বিদেশি ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নোয়াবেন না। লড়াই চালিয়ে যাবেন শেষ বল পর্যন্ত। শুধু মুখের কথা নয়, ক্ষমতা হারানোর পর আন্দোলনের ময়দানে নেমে প্রাক্তন পাক ক্রিকেট অধিনায়ক বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, রাজনীতির ম্যাচ জিততেও লড়াই চলবে তার।
ঘটনাচক্রে, পাক বিচারবিভাগও গত তিন মাসে অনেক ক্ষেত্রে পাশে দাঁড়িয়েছে ইমরানের। শাহবাজ সরকার বলপ্রয়োগ করে ইসলামাবাদের ডি-চকের উদ্দেশে ইমরানের ‘আজাদি মার্চ’ রোখার চেষ্টা করলেও তাতে বাদ সাধে পাকিস্তানের শীর্ষ আদালত। ওই রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে অশান্তি এবং ধর্মদ্রোহের অভিযোগে ইমরানের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হলেও তাঁর গ্রেফতারিতে পাক সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
পাক পঞ্জাবের আইনসভার ওই ২০টি আসন ছিল ইমরানের পিটিআইয়ের দখলে। কিন্তু গত মার্চে পাক পার্লামেন্টের পাশাপাশি পঞ্জাব আইনসভাতেও ইমরানের দলে ভাঙন ধরেছিল। বিদ্রোহীরা শরিফদের সঙ্গে হাত মেলানোয় মুখ্যমন্ত্রিত্ব হারাতে হয় পিটিআই নেতা উসমান বুঝদরকে। কুর্সিতে বসেন হামজা। কিন্তু এর পর ইমরানের আবেদন মেনে নিয়ে নির্বাচন কমিশন দলত্যাগী সদস্যদের বরখাস্ত করে উপনির্বাচন ঘোষণা করে।
পঞ্জাবের উপনির্বাচনের এ বার মাটি কামড়ে প্রচার চালিয়েছিলেন ইমরান। দলত্যাগীদের অনেককেই প্রার্থী করেছিল পিএমএল (এন)। তাদের ‘গদ্দার’ বলে তুলে ধরেছিলেন তিনি। ভোটের ফল বলছে, সেই অভিযোগ মানুষ বিশ্বাস করেছে। পাশাপাশি, গত তিন মাসে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব নিয়েও শাহবাজ ও হামজা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই উপনির্বাচনে। বিশেষত, প্রবল আর্থিক সঙ্কটের আবহে শাহবাজ যে ভাবে জ্বালানিতে ভর্তুকি ছাঁটাই করেছেন, তাতে রোষ বেড়েছে দেশ জুড়ে।
গত কয়েক বছরে পাক রাজনীতির ধাঁচও অনেকটাই বদলে গিয়েছে বলে সে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন। তাঁদের মতে, পিএমএল (এন) বা পিপিপির মতো পরিবার-নির্ভর পুরনো দলের প্রভাব ক্রমশ কমছে। রাজনৈতিক আনুগত্যের উত্তরাধিকার নয়, পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে তাঁদের সমস্যা সমাধানের অঙ্গীকার। পঞ্জাবে উপনির্বাচনের ফল বলছে, নয়া প্রজন্ম ভরসা রাখছে ইমরানের ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার প্রতিশ্রুতিতে। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানের ভোটারদের ২০ শতাংশেরও বেশি নতুন প্রজন্মের।
যদিও পাকিস্তানের ইতিহাস বলছে, সে দেশে সব সময় জনসমর্থনের নিরিখে ভোটে জেতা যায় না। রাজনীতির উত্থান-পতনের নেপথ্যে বড় ভূমিকা থাকে পাক সেনাবাহিনীর। ২০১৮-র পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় পাক সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বস্তুত, সে সময় সেনার বিরুদ্ধে ইমরানকে ভোটে জেতানোর জন্য কারচুপির অভিযোগও করেছিল পিএমএল (এন) এবং পিপিপি। কিন্তু চার বছরে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে অনেকটা। সরাসরি জেনারেল বাজওয়ার নাম না করলেও ইমরান এবং তার দলের নেতারা ক্ষমতা হারানোর জন্য দায়ী করেছেন সেনার এক ‘প্রভাবশালী অংশকে’।
২০২১ সালে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ ঘিরেই ইমরানের সঙ্গে জেনারেল বাজওয়ার বিরোধের সূত্রপাত। সে সময় আইএসআই প্রধান হিসেবে বাজওয়া-ঘনিষ্ঠ লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমের নিয়োগে আপত্তি করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান। বহাল রাখতে চেয়েছিলেন ‘বাজওয়া-বিরোধী’ হিসাবে পরিচিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফৈজ হামিদকে। যদিও সেনার চাপে শেষ পর্যন্ত ইমরানকে মতবদল করতে হয়েছিল।
সেনার মতোই গত সাড়ে সাত দশকে বার বার পাক রাজনীতিতে আমেরিকার ‘প্রভাব’ দেখা গিয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর ইমরানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সখ্যও চোখ টেনেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরে। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি থেকে উৎখাত হওয়ার পর ইমরান সরাসরি অভিযোগ করেন, তার সরকারের পতন ঘটাতে ষড়যন্ত্র করেছে আমেরিকা!
আগামী বছরের পার্লামেন্ট ভোটের আগে সেই ‘পিচ’ কতটা মেরামত করা যায়, তার উপর ইমরানের ভোট-ভাগ্য অনেকটা নির্ভর করছে বলেই পাক রাজনীতির সাথে জড়িতরা মনে করছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ