শ্রীলঙ্কার অষ্টম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন রণিল বিক্রমাসিংহে। দেশটির প্রধান বিচারপতি বৃহস্পতিবার তাকে শপথ পড়ান। ৭৩ বছর বয়স্ক রণিল এর আগে ৬ বার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া দুই বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে নেমেও ব্যর্থ হন তিনি। অবশেষে তৃতীয় বারের চেষ্টায় দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভ করলেন রণিল বিক্রমাসিংহে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন রণিল বিক্রমাসিংহে। তবে তাকে মানতে নারাজ গত কয়েক মাস ধরে রাস্তায় থাকা আন্দোলনকারীরা। সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগের পর থেকেই বিষয়টি বলে আসছিলেন তারা। কিন্তু তারপরেও গণতান্ত্রিক উপায়ে পার্লামেন্টের ভোটে প্রেসিডেন্ট পদে জয় পেয়েছেন রণিল বিক্রমাসিংহে।
আল-জাজিরার সাংবাদিক মিনেলে ফার্নান্দেজ শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলোম্বো থেকে জানিয়েছেন, পার্লামেন্টের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নারাজ বিক্ষোভকারীরা। তারা আবারও বড় আন্দোলনে যাচ্ছেন। রণিল বিক্রমাসিংহেকে রাজাপাকসে পরিবারের মিত্র বলেই ধরে নেয়া হয়। তাই তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আন্দোলনকারীরা মানতে পাড়ছে না। তারা মনে করেন, বিক্রমাসিংহেকে জেতাতে রাজাপাকসে পরিবারই হস্তক্ষেপ করেছে। আর এ কারণেই দেশজুড়ে এতো ক্ষোভ।
যে প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছে তা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে আন্দোলনকারীদের।
স্বাধীনতার পর সবথেকে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত শ্রীলঙ্কা। দেশের এই পরিণতির জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে দায়ী করছেন অনেক শ্রীলঙ্কান।
এ জন্য তারা এ বছরের প্রথম থেকেই আন্দোলন করে আসছেন। অবশেষে আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন গোতাবায়া। পরিবর্তন আসে শ্রীলঙ্কার সরকারের সর্বস্তরেই। কিন্তু তারপরেও খুশি নন আন্দোলনকারীরা। তারা এখন বলছেন, রণিল বিক্রমাসিংহে সেই রাজাপাকসেদের ছায়া হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত রণিলের হাতেই ক্ষমতা এটা তারা মানতে পারছেন না। গোতাবায়াকে সরাতে তারা সফল হলেও আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থই হলো।
বিষয়টি নিয়ে সামনেই বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার খবরে বুধবারই এক দফা বিক্ষোভ করেছেন এ বছরের প্রথম থেকে রাস্তায় থাকায় আন্দোলনকারীরা। তাদের দাবি, তারা দেশের ক্ষমতায় থাকা মানুষদের সরিয়ে নতুন নেতৃত্ব দেখতে চেয়েছেন, কিন্তু রণিল বিক্রমাসিংহে সেই রাজাপাকসেদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
বিবিসির খবরে জানানো হয়েছে, আন্দোলনের নেতারা কোনোভাবেই রণিলকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানবেন না। যদিও গত মে মাস থেকেই শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে বেশ কিছু প্রচেষ্টাও গ্রহণ করা হয়েছে এই সময়ের মধ্যে। তারপরেও বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের শিকার হতে হয়েছে তাকে। হামলা হয়েছে তার সরকারি দপ্তর ও বাসভবনে। জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে তার নিজের বাড়ি।
এই একই আন্দোলনকারীরা সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকেও দেশ ছাড়া করে।
বিদেশেই পদত্যাগে বাধ্য হন রাজাপাকসে। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ক্ষমতা ছাড়েন তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন রণিল। বুধবার পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট হয়। এতে ১৩৪ ভোট পেয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রণিল বিক্রমাসিংহে।
তবে এ খবর বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়েন আন্দোলনকারীরা। তারা মনে করছেন, তাদের মাসের পর মাস ধরে চলা আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। যদিও কিছুটা পরিবর্তন আসছে তাদের দাবিতে। তারা এবার সরাসরি সংবিধান পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। একইসঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাসের কথাও বলছে বিক্ষোভকারীরা। এক বছরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবিও রয়েছে তাদের। এসব দাবি না মানলে সেই আগের মতো অস্থির অবস্থা হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে আন্দোলনকারীরা দখল করে নেয়া সরকারি ভবনগুলো ফেরত দিয়েছে। এখন তারা বলছেন, শেষ পর্যন্ত রণিলের হাতেই ক্ষমতা এটা তারা মানতে পারছেন না। গোতাবায়াকে সরাতে তারা সফল হলেও আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থই হলো। তারা চান, একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ নেতা নির্বাচন করা হোক।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এলাকায় এখনো স্বল্পসংখ্যক বিক্ষোভকারী অবস্থান করছেন। সেখানকার ভবনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তাদের ‘রনিল বিদায় হও’ স্লোগান দিতে দেখা যায়।
তবে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একধরনের হতাশা লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে নুজলি হামিম নামের শীর্ষস্থানীয় এক আন্দোলনকারী বলেন, ‘টানা চার মাসের আন্দোলনে লোকজন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।’
গত সপ্তাহে বিক্ষোভকারীরা অধিকাংশ সরকারি ভবনের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন। তবে ‘গল ফেস’ নামে পরিচিত সমুদ্রতীরবর্তী ছোট্ট এলাকায় অবস্থিত প্রেসিডেন্টের সচিবালয় এখনো বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান পরিবর্তন, প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কমানোসহ বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন নুজলি হামিম। জনগণের ‘হাঁফ ছেড়ে বাঁচার’ ব্যবস্থার পর এক বছরের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বিক্রমাসিংহের শক্তিশালী পূর্বসূরিদের সফলভাবে উৎখাত করেন বিক্ষোভকারীরা। এখন শ্রীলঙ্কাকে বিক্রমাসিংহের সঙ্গে ‘আপস’ করতে হচ্ছে দেখে হতাশ নুজলি হামিম। তবে তিনি বলেন, যখন জাতীয় নির্বাচন হবে, তখন জনগণ বুঝতে পারবে, কী হিসাব করে ভোট দিতে হবে।
অনিল নামের এক ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এই লোকগুলো ৭০ বছর ধরে দেশ শাসন করেছেন। তারা চুরি করে আসছেন। আমরা কীভাবে আশা করি, ভালো কিছু হবে।’
অনিল আরও বলেন, তাদের উচিত, এই লোকগুলোকে ক্ষমতা থেকে তাড়ানো। তারা যদি পরিবর্তন চান, তাহলে নতুন কাউকে প্রয়োজন।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্রমাসিংহে গতকাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বিক্ষোভকারীদের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বিক্রমাসিংহে বলেছেন, বিক্ষোভের নামে কেউ অগণতান্ত্রিক পন্থার আশ্রয় নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সহিংসতার কাছে মাথা নত করবেন না বলে জানান ছয়বারের এই প্রধানমন্ত্রী।
রাজধানী কলম্বোয় একটি বৌদ্ধমন্দিরে প্রার্থনা শেষে বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে বিক্রমাসিংহে বলেন, ‘তোমরা যদি সরকার উৎখাতের চেষ্টা করো, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল করে রাখো, তবে তা গণতন্ত্র নয়। এগুলো আইনের পরিপন্থী কাজ।’
বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনপ্রত্যাশী নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠদের আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত করতে চাওয়া স্বল্পসংখ্যক বিক্ষোভকারীকে আমরা কোনো সুযোগ দেব না।’
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরপরই বিক্রমাসিংহে পার্লামেন্টের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের বিশেষ শাখা ও সেনা ইউনিটের সঙ্গে দেখা করেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকের সুরক্ষা দেওয়ায় তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫১
আপনার মতামত জানানঃ