আপনি যা করেন কিংবা করতে ব্যর্থ হোন, তার ৯৫% নির্ভর করে আপনার অভ্যাসের ওপর। আপনার অভ্যাসগত ধারণা ও আচরণগত ধারণার ওপর আপনার কর্মকান্ড নির্ভর করে। অভ্যাসগত ধারণা হলো- আপনি জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকে যেভাবে পরিচালিত করেন। আর আচরণত অভ্যাস হলো- আপনি যা করতে অভ্যস্ত কিংবা অভ্যস্ত নন।
সফলতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলোৈ মানুষের খারাপ অভ্যাস। কখনো কখনো সেগুলো অচেতনভাবে মনে ভেতরে রয়ে যায় এবং বছরের পর বছর ধরে ব্যক্তির সর্বোচ্চ সক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে দমিয়ে রাখে।
তবে ভাল খবর হলো, যাবতীয় অভ্যাসসমূহ (অভ্যাসগত ধারণা ও আচরণত অভ্যাস) আমাদের শেখা। যেহেতু অভ্যাসগুলো শেখা যায়, তাই সেগুলো ভুলে যাওয়া কিংবা বাতিলও করা যায়। নতুন অভ্যাসের চর্চা করে পুরানো অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা যায়। পুরোনো বাজে অভ্যাসগুলোর বদলে নতুন ইতিবাচক, উপকারি অভ্যাসের চর্চা করে নিজেকে সামনে এগিয়ে নেওয়া যায়। ভাল অভ্যাসের চর্চা করলে আপনি দারুণ সব কাজ করতে পারবেন, ফলে আপনার উপার্জন বাড়বে এবং আপনার দ্রুত উন্নতি হবে।
“আমরা প্রথমে অভ্যাস তৈরি করি, পরবর্তীতে অভ্যাস আমাদেরকে তৈরি করে।” – জন ড্রাইডেন
নতুন ও উন্নত অভ্যাসের চর্চা
নতুন তথ্য নেওয়ার মাধ্যমে অভ্যাস তৈরি হয়। সেই অভ্যাস আমাদের জন্য ভাল হতে পারে, খারাপও হতে পারে। এরপর সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া পদক্ষেপগুলো বারবার পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে সেটা আমাদের ভেতরে বসে যায় এবং একপর্যায়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করতে শুরু করে। আমরা তখন আর সেই কাজ বা পদক্ষেপের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করি না, শুধু করে যাই।
নিজের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ ধারণার ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে বাজে অভ্যাসগুলো গড়ে ওঠে। অর্থাৎ, আপনি নিজেকে আগেই কোনো কাজের ব্যাপারে গুটিয়ে নেন, ভাবেন কাজটা আপনাকে দিয়ে হবে না। অথচ চেষ্টা করলে হয়তো ঠিকই পারতেন। এধরনের ধারণার ফলে আপনি নিজেকে গুটিয়ে নেন এবং আপনার পক্ষে সেই কাজ করা সত্যিকার অর্থেই সম্ভব হয় না। কারণ আপনি কাজটা করেননি। পুরোনো একটা প্রবাদ আছে, ‘আপনি নিজেকে যা ভাবেন আপনি তা নন। আপনি যা ভাবেন, সেটাই আপনি।’
“সম্ভবত মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার হলো এই তথ্য জানা যে, আপনি অধিকাংশ সময় যা নিয়ে ভাবেন আপনি সেটাতেই পরিণত হন।” – ব্রায়ান ট্রেসি
নিজের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করুন
বড় সফলতা পাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হলো নিজের স্বয়ংক্রিয় অভ্যাস, ধারণা এগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা। আপনাকে একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখতে হবে, আপনার অভ্যাস ও ধারণাগুলো আপনার সফলতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিনা, আপনাকে পিছিয়ে রাখছে কিনা।
অনেকে মনে করে, তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান নয় কারণ তারা ছাত্রজীবনে ভাল ফলাফল করেনি, ভাল গ্রেড পায়নি। কিন্তু দেখা যায় বিভিন্ন জটিল ও কঠিন ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছেন, তিনিও ছাত্রজীবনে ভাল গ্রেড অর্জন করতে পারেননি। তাহলে?
কিছু মানুষ সফল হতে পারে না কারণ তারা ভাবে তাদের সৃজনশীলতা নেই, তারা ক্রিয়েটিভ নয়, তারা জীবনে শৃঙ্খলা মেনে চলে না, সময়কে কাজে লাগাতে পারে না, সময়নিষ্ঠ নয় কিংবা তাদের নতুন কিছু শিখে এবং সেটাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা নেই। তারা বলে, ‘আমি তো এমনই।’ তারা এভাবে গা ছেড়ে দেয় এবং ভাবে এসব কারণেই তাদের উন্নতি হচ্ছে না।
কিন্তু আসল ঘটনা হলো- নিজের ব্যাপারে এধরনের সীমাবদ্ধ চিন্তা-ভাবনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হয়; এগুলো সত্য নয়। আপনি যে তথ্যসমূহ গ্রহণ করেছেন, আপনার ধারণাগুলো সেই তথ্যসমূহের ওপরেই ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। কখনো কখনো সেই তথ্য এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তির মন্তব্য ও সমালোচনা থেকে, আবার কিছু তথ্য এসেছে নিজের রাশিফল পড়ার মাধ্যমে।
“এমনভাবে চলুন যেন আগামীকালই আপনার জীবনের শেষ দিন। এমনভাবে শিখুন যেন আপনি আজীবন বেঁচে থাকবেন।” -মহাত্মা গান্ধী
সফলতার চাবিকাঠি
আপনি ভাল-মন্দ যা-ই করেন না কেন, সেগুলোর ৯৫% নির্ভর করে আপনার স্বভাবের ওপর, অভ্যাসের ওপর। তাই ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে হলে আপনার নতুন নতুন অভ্যাস রপ্ত করতে হবে। আপনি যেধরনের মানুষ হতে চাচ্ছেন এবং যা অর্জন করতে চাচ্ছেন, নতুন অভ্যাসগুলো যেন সেগুলোর সাথে মানায়।
সত্যি বলতে, বাজে অভ্যাস গড়ে তোলা খুবই সহজ কিন্তু সেগুলো নিয়ে বাঁচা কঠিন। অন্যদিকে ভাল অভ্যাসগুলো রপ্ত করা কঠিন কিন্তু সেগুলো নিয়ে বেঁচে থাকা সহজ।
তবে মজার ব্যাপার হলো, একবার যদি আপনি একটি ভাল নতুন অভ্যাস রপ্ত করতে পারেন, খুব জলদি সেটা আপনার সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনি সেই অভ্যাসানুযায়ী কাজ করতে থাকেন। মোটের ওপর, ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, পুরোনো বাজে অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার পথটাও কঠিন হয়ে যায়। কারণ নতুন অভ্যাস আপনাকে যে প্রশান্তি ও তৃপ্তি দেয়, আপনি সেগুলো হারাতে চান না।
“সফলতা একটি পরিণতি মাত্র, সফলতা কোনো লক্ষ্য নয়।” -গুস্তাভ ফ্লুবে (ফ্রেঞ্চ ঔপন্যাসিক)
নতুন অভ্যাস রপ্তের বিভিন্ন পর্যায়
আপনি কীভাবে একটি নতুন, পজেটিভ অভ্যাস রপ্ত করবেন? যেভাবে আপনি পুরোনো বাজে অভ্যাসটি রপ্ত করেছিলেন, ঠিক সেভাবে। অর্থাৎ, চর্চা ও পুনরাবৃত্তি করবেন। নিচে বিস্তারিত ফর্মূলা দেয়া হলো :
- একবার একটি অভ্যাস রপ্ত করুন। সহজ কিছু দিয়ে শুরু করুন। সফলতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের একটি গুণ রপ্ত করার মাধ্যমে শুরু করতে পারেন। গুণটির নাম : সময়নিষ্ঠ হওয়া।
- সিদ্ধান্ত নিন, এই মুহূর্ত থেকেই আপনি সময়নিষ্ঠ হবেন। নতুন অভ্যাস রপ্ত করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা অনেক বড়ধরনের বাজে প্রভাব ফেলে। অধিকাংশ মানুষ লো লেভেলে বা নিচু অবস্থানে থাকে কারণ তারা কখনো হায়ার লেভেলে বা উঁচু স্তরে কাজ করার সিদ্ধান্তই নেয় না।
- নিজেকে বোঝান আপনি ইতিমধ্যে নতুন অভ্যাসটি রপ্ত করে ফেলেছেন। নিজেকে বলুন, “আমি এখন থেকে প্রতিটি মিটিঙে, প্রতিটি জায়গায় সঠিক সময়ে যাব।”
এভাবে চর্চা করতে থাকুন, পুনরাবৃত্তি চালিয়ে যান, যতক্ষণ না আপনার অবচেতন মনে ব্যাপারটা নির্দেশ হিসেবে গেড়ে না বসছে। একবার আপনার মনে বিষয়টা বসে গেলে দেখতে পাবেন, আপনি চমৎকারভাবে সময়নিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এবং নিজের সময়নিষ্ঠতা উপভোগ করছেন।
ফুটবল কোচ ভিন্স লমবার্ডি তার লমবার্ডি টাইমের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। লমবার্ডি টাইম কী? মূল সময়ের ১৫ মিনিট আগের সময়কে লমবার্ডি টাইম বলে। যদি বাস ছাড়ায় সময় থাকতো সকাল ৯ টায়, তাহলে সকল খেলোয়ারকে ৮ টা ৪৫ মিনিটে ওখানে হাজির হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। হাজির না হতে পারলে বাস তাকে রেখেই চলে যেত।
নিজের জীবনের সকল ক্ষেত্রে লমবার্ডি টাইম প্রয়োগ করুন। আপনার প্রতিটি কাজে, অ্যাপয়েন্টমেন্টে যথাসময়ে নয়, বরং ১০-১৫ মিনিট আগে পৌঁছুনোর সিদ্ধান্ত নিন। - কল্পনা করুন আপনি ইতিমধ্যে সময়নিষ্ঠ হওয়ার গুণটি অর্জন করে ফেলেছেন। মাথার ভেতরে নিজের ব্যাপারে একটি পরিষ্কার ছবি আঁকুন। যেভাবে আপনি নিজেকে ভবিষ্যতে দেখতে চান। মনে রাখবেন : নিজেকে ভবিষ্যতে কোন অবস্থায় দেখছেন তা কল্পনার মধ্য দিয়েই আপনার যাবতীয় ব্যক্তিগত উন্নতির যাত্রা শুরু হবে।
- এমনভাবে চলুন যেন আপনার আকাঙ্খিত অভ্যাসটি ইতিমধ্যে আপনার মধ্যে আছে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, “যদি আপনি সবচেয়ে সময়নিষ্ঠ ব্যক্তি হতাম, তাহলে কীভাবে চলতাম?” অন্য সময়নিষ্ঠ ব্যক্তিরা কীভাবে নিজেকে পরিচালনা করে, নিজেকেও সেভাবে পরিচালনা করুন। এমন একটি ভান করুন যেন আপনি ইতিমধ্যে একজন সময়নিষ্ঠ ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেছেন।
- সময়নিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার পর আপনার নিজের ভেতরে কেমন গর্ব, আনন্দ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকতো, সেই অনুভূতিগুলো তৈরি করুন। এই অনুভূতিগুলো আপনার অবচেতন মনে নতুন অভ্যাসটিকে বসিয়ে দিতে সহায়তা করবে। ফলে অভ্যাসটি আপনার কাছে সহজ, দ্রুত এবং স্বয়ংক্রিয় একটি ব্যাপার বলে মনে হবে।
মজার ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কোনো পজেটিভ নতুন অভ্যাসের চর্চা করলে, সেটা আপনাকে অন্যান্য পজেটিভ অভ্যাস রপ্ত করার ক্ষেত্রেও দারুণভাবে সহায়তা করবে। ঠিক তেমনি আপনি যদি একটি নতুন অভ্যাস রপ্ত করায় কোনো ঢিলেমি দেখান, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে অন্যান্য পজেটিভ অভ্যাস রপ্ত করতে গেলেও আপনাকে বেশ ভুগতে হবে।
তথ্যসূত্র :
Just Shut Up and Do It: 7 Steps to Conquer Your Goals Book by Brian Tracy
আপনার মতামত জানানঃ