ভারতে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবার যেভাবে গরু রক্ষা নিয়ে মেতে রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এবারের ঈদে গরু, উট বা অন্যান্য পশু কোরবানি নিয়ে অশান্তির মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে।
মুসলিমদের কাছে বড় দুই উৎসবের অন্যতম এই কোরবানির ঈদ। আর এই ঈদে গবাদিপশু, উট, দুম্বা কোরবানি দেয়া মুসলিমদের ধর্মীয় রীতির মধ্যে পড়ে। কিন্তু এ বছর গবাদিপশু হত্যা এবং পরিবহনের ওপরে বিধিনিষেধ আরোপ করে সব রাজ্যকে চিঠি পাঠিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
অবশ্য চিঠিটি পাঠানো হয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ভারতীয় প্রাণিকল্যাণ বোর্ডের পক্ষ থেকে। কিছুদিন আগেই রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং রাজ্য প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্তাদের চিঠি পাঠিয়ে ভারতীয় প্রাণিকল্যাণ বোর্ডের সচিব এম রবিকুমার নির্দেশ দিয়েছেন, কোরবানির ঈদে অবাধে গরু, বাছুর, উট এবং অন্যান্য পশুর নিধন চলবে না। অবৈধ উপায়ে গবাদিপশুর পরিবহন যেন না হয়, রাজ্যগুলোকে তাও নিশ্চিত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কোরবানি বন্ধ করতে প্রাণিকল্যাণ বোর্ড কড়া নির্দেশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ভারতে কোথাও কোরবানির জন্য গরু বা উট নিধন করতে দেয়া যাবে না। এমনকি কোরবানির ঈদের আগে যারা অবৈধভাবে পশু পরিবহন করছেন এবং ঈদের দিন যারা আইন ভাঙবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলা হয়েছে।
পশু হত্যাবিরোধী আইন এবং আদালতের বিভিন্ন রায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ করা হয়েছে সেই চিঠিতে। আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথাও একাধিকবার লেখা হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন দপ্তর জুন মাসের ১৮ তারিখে একটি নির্দেশিকা দিয়েছিল, যার ভিত্তিতে এখন জেলা প্রশাসনগুলি তাদের অধীনস্থ দপ্তরগুলিতে চিঠি পাঠিয়ে বলেছে যে বকরি ঈদের আগে ‘বেআইনি পশু হত্যা’ বন্ধ করতে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
যেসব পশুর নাম রয়েছে ওই নির্দেশিকায়, তার মধ্যে গরু, বাছুর এবং উটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মূল নির্দেশিকার পরে বাংলায় একটি ‘কী করা যাবে, কী করা যাবে না’ ধরণের তালিকা রাজ্য সরকার দিয়েছে, যেখানে ভেড়া, ছাগল, শুকর, গৃহপালিত পশু, মুরগি আর মাছের কথা লেখা আছে।
নির্দেশিকায় এটাও বলা হয়েছে যে ভারতের পশু কল্যাণ পর্ষদের নির্দেশিকা অনুযায়ীই এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নির্দেশ দিয়েই প্রাণিকল্যাণ বোর্ড হাত গুটিয়ে বসে থাকছে না। রাজ্য সরকারগুলো বোর্ডের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে তাও বিস্তারিতভাবে বোর্ডকে জানাতে বলা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এ চিঠি এসেছে।
জানা গেছে, বোর্ডের চিঠিতে যেভাবে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে তা অনুসরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে ত্রিপুরার প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী ভগবান দাস বিবিসিকে জানিয়েছেন তারা কোরবানি বন্ধ করার কোনও নির্দেশ দেননি, তবে নিয়ম মেনেই পশু জবাই করতে হবে।
এছাড়াও, তিনি বলেন, “অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবাবেগে আঘাত” যাতে না লাগে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, “এটা আমার দপ্তর থেকে গত মাসের ১৮ তারিখ দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রাণীসম্পদ পর্ষদ প্রত্যেক রাজ্যের কাছে যে নির্দেশনা পাঠিয়েছিল, সেটাই জেলা প্রশাসনগুলোকে আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি। এর দুটো উদ্দেশ্য। প্রথমত যেভাবে গরু বা পশুগুলিকে পরিবহন করে নিয়ে আসা হয়, সেটা একটা নিষ্ঠুরতা। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।”
মন্ত্রী আরও বলছিলেন, নির্দেশিকা জারি করার পিছনে দ্বিতীয় কারণটা হল- তার ভাষায়- “যেভাবে প্রকাশ্যে কসাইখানা বানিয়ে ফেলে, যেখানে সেখানে গরু কাটে, সেটা অনেকের কাছেই খুব খারাপ লাগে। বিশেষত শিশুদের মনে এর খুব খারাপ প্রভাব পড়ে। এই দিকটাও খেয়াল রাখা দরকার।”
এই নির্দেশিকা এটাই ইঙ্গিত করছে যে উত্তরপ্রদেশ সহ নানা রাজ্যে যে ধরণের নিষেধাজ্ঞা আছে, বা পার্শ্ববর্তী আসামেও যেরকম কড়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে গরু জবাইয়ের ওপর এখানেও হয়তো নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ চালু করা হবে।
সরকারী নির্দেশে না থাকলেও মন্ত্রী ভগবান দাস বলেন “এমন সম্প্রদায়ের মানুষও আছেন, যারা গরুকে শ্রদ্ধা ভক্তি করেন।” তিনি বলেন, কোরবানির ঈদে গরু জবাই করার সময়ে তাদের ভাবাবেগে যাতে আঘাত না লাগে, সেটাও দেখা উচিত।
ত্রিপুরায় শাসনক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি। দেশের প্রায় সব বিজেপি শাসিত রাজ্যেই গরু জবাই করার ওপরে হয় নিষেধাজ্ঞা অথবা কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে।
ত্রিপুরায় সেই নিয়ন্ত্রণ এতদিন ছিল না।
ত্রিপুরা রাজ্য ইমাম অর্গানাইজেশনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “এই নির্দেশিকা এটাই ইঙ্গিত করছে যে উত্তরপ্রদেশ সহ নানা রাজ্যে যে ধরণের নিষেধাজ্ঞা আছে, বা পার্শ্ববর্তী আসামেও যেরকম কড়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে গরু জবাইয়ের ওপর এখানেও হয়তো নিষেধাজ্ঞা বা নিয়ন্ত্রণ চালু করা হবে।”
আবার রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও সিপিআইএম নেতা শাহিদ চৌধুরী প্রশ্ন তুলছেন, “কোরবানির কারণে এতবছর তো কারো ভাবাবেগে আঘাত লাগেনি, এখন এই কথা সরকার কেন তুলছে?”
সরকারি নির্দেশিকার পরে রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যে যেমন তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি, তেমনই ভয়।
এদিকে ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যাতে কোরবানি ঈদ তথা ঈদুল আযহা নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে সেজন্য স্মারকলিপি পেশ করেছে জন অধিকার সংগ্রাম পরিষদ।
শুক্রবার (৮ জুলাই) পশ্চিম জেলা শাসকের কাছে এই স্মারকলিপি পেশ করে সংগঠনের একটি প্রতিনিধি দল।
গত বছর ঈদুল আযহার কোরবানির সময় আক্রান্ত হয়েছেন রাজ্যের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমরা। রাজ্যের কিছু অত্যুৎসাহী উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।
এমনই অভিযোগ আনেন জন অধিকার সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রবীণ সিংহ।
তিনি বলেন, আগামী ১০ জুলাই কোরবানি ঈদ পালন করবেন মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা।
চলতি বছর যাতে কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার জন্যই জন অধিকার সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পশ্চিম জেলা শাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এ জাতীয় ঘটনায় প্রশাসন যাতে নিরপেক্ষ এবং শক্ত ভূমিকা নেয় তার জন্যও আবেদন থাকবে সংগঠনের।
রাজ্যের আটটি জেলার জেলা শাসকের কাছেই এই স্মারকলিপি পেশ করেছে জন অধিকার সংগ্রাম পরিষদ।
ত্রিপুরায় ৩৮ লক্ষ মানুষের মধ্যে নয় শতাংশ মুসলমান। ত্রিপুরায় আগে কখনই সাম্প্রদায়িক অশান্তি লক্ষ্য করা যায়নি।
কিন্তু গত কয়েক বছরে কখনও মুসলমানদের বাড়ি-দোকান ভাঙচুর, মসজিদ ভাঙচুর বা অতি সম্প্রতি কবরস্থান দখল করে গেরুয়া পতাকা টাঙ্গিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২২০৯
আপনার মতামত জানানঃ