[zoomsounds_player artistname=”স্টেটওয়াচ পডকাস্ট” songname=”দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী বক্তব্যের পাঠক-শ্রোতা-দর্শক ক্রমশ বাড়ছে” type=”detect” dzsap_meta_source_attachment_id=”30010″ source=”https://statewatch.net/wp-content/uploads/2022/07/ধর্মীয়-উগ্রবাদি-বক্তব্যের-পাঠক-শ্রোতা।.mp3″ config=”default” autoplay=”off” loop=”off” open_in_ultibox=”off” enable_likes=”off” enable_views=”off” enable_rates=”off” play_in_footer_player=”default” enable_download_button=”off” download_custom_link_enable=”off”]
আমাদের বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অনেক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। যেসব পরিবর্তন এসেছে, তার অনেকগুলোই হতাশাজনক। সহজে বলে দেয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক যে দেশ গড়ার কথা ছিল, সে দেশটি আসলে গড়ে তোলা যায়নি। বরং, ধর্মব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে গেছে দেশ। খুবই সূক্ষ্মভাবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সালাফি মতবাদ। সুকৌশলে ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটি করা হয়েছে।
চাতুরীর সঙ্গে ওয়াজ মাহফিলে সংবিধানবিরোধী বক্তব্য রাখা হয়েছে বহু জায়গায়। সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদের নামে অরাজকতার উস্কানি দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মসজিদে খুতবার সময় সংবিধানবিরোধী কথাবার্তা বলা হয়েছে। আর এর সবকিছুই করা হয়েছে ধর্মের নাম ভাঙিয়ে। পরমতসহিষ্ণুতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে ধর্মান্ধতার চাষাবাদ করা হয়েছে। দেশের জনগণের একটা বড় অংশ যে এদের প্রচারণায় প্রলুব্ধ হয়েছে, সেটা না বললেও বোঝা যায়।
বাংলাদেশে উগ্রবাদী বক্তব্যের পাঠক-শ্রোতা-দর্শক ক্রমশ বাড়ছে। তরুণদের একটি বড় অংশ বাঙালি বা বাংলাদেশি পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে বেশি। এতে সামাজিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। বাঙালির উদার ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র মুছে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে কর্মরত দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলা হয়েছে। তারা ঘনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যালোচনা করে থাকে। স্পর্শকাতর তথ্য বিবেচনায় সংস্থা দুটি নাম প্রকাশ করতে চায়নি।
উগ্র মতাদর্শের প্রচার কতটা বেড়েছে, প্রতিবেদনের তথ্যে তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এতে বলা হয়, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১ হাজার ৫৩টি চ্যানেল ব্যবহার করে উগ্রবাদী তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এসব চ্যানেলের গ্রাহক এখন ১ কোটি ১১ লাখ।
উগ্রবাদী এসব চ্যানেলে প্রচারিত ৫৮৪টি পোস্টে ২৯ লাখ মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চ্যানেলের সংখ্যা ছিল ৯১৩টি, গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৪ লাখ। এসব চ্যানেলের বেশির ভাগ চালাচ্ছে আল-কায়েদার অনুসারী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। মানুষ কখনো কখনো না জেনে, না বুঝে এসব চ্যানেলের তথ্য শেয়ার করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উগ্রবাদী এসব চ্যানেলে আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের খবর, ভারত ও হিন্দু জনগোষ্ঠী, কাশ্মীর পরিস্থিতি, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, নারীবাদ, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারবিরোধী প্রচার।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুর্গাপূজা সামনে রেখে ভারত ও হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আলোচনা বেড়েছে।
উগ্রবাদী চ্যানেল থেকে এ সময় যত আধার প্রচারিত হয়েছে, তার ৬০ ভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি দেশ ও দেশের বাইরের মুসলমানদের উসকে দিতে এই সময়কে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
প্রতিবেদনে মাঠের পরিস্থিতি ও অনলাইনে উগ্রবাদীদের তৎপরতার একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। যেমন গত বছরের ১৩-১৭ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন জেলায় পূজামণ্ডপে ভাঙচুর চালানো হয়। ঠিক ওই সময়ে অনলাইনে হিন্দুবিদ্বেষী বার্তার সংখ্যা শীর্ষে পৌঁছায়। টানা পাঁচ দিন ধরে চলা সহিংসতার জন্য হিন্দুরাই দায়ী—অনলাইনে এমন অপপ্রচার ছড়ানো হয়।
তরুণদের একটি বড় অংশ বাঙালি বা বাংলাদেশি পরিচয়ের চেয়ে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছে বেশি। এতে সামাজিক অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। বাঙালির উদার ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র মুছে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
এর কয়েক দিন পর গত বছরের ২২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আয়োজিত কনসার্টে ‘মেঘদল’-এর জনপ্রিয় একটি গানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে প্রচার চালানো হয়। মেঘদলকে ইসলাম অবমাননার জন্য দায়ী করে পোস্ট করা হতে থাকে। পোস্টগুলোতে গানের মাধ্যমে মুসলমানদের নির্যাতন করা হচ্ছে—এমন একটা দৃশ্যপট তৈরির চেষ্টা হয়।
গত বছরের ১১ ও ২৮ নভেম্বর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৫ জন নিহত হন। ৩০ নভেম্বর আনসার আল ইসলাম পরিচালিত একটি চ্যানেলের ভিডিও বার্তায় বলা হয়, গণতন্ত্র মুসলমানদের দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধার একটি মাধ্যম। একইভাবে বুয়েটের আবরার হত্যার রায় ঘোষণা ও অভিজিৎ রায়ের হত্যা সম্পর্কে তথ্য চেয়ে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা নিয়ে আনসার আল ইসলাম নিজস্ব মত প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদকে উসকে দেয়, এমন চ্যানেলগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানতে পারছে না। অনেকে না বুঝে এসব চ্যানেলে প্রচারিত তথ্যে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন বা শেয়ার করছেন।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, দুর্গাপূজার সময় পূজামণ্ডপে হামলা, শিক্ষার্থীদের হাতে মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে হেনস্তা, ঢাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষিকাকে টিপ নিয়ে পুলিশ সদস্যের কটূক্তি ও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টিপ নিয়ে অপপ্রচার, নরসিংদীতে পছন্দমতো পোশাক পরায় নারীকে মারধর, নড়াইলে কলেজশিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে লাঞ্ছনা—এই সবই এক সুতায় গাঁথা। এর পেছনে অসহিষ্ণুতা ও উগ্র মতাদর্শের প্রভাব রয়েছে।
বাংলাদেশের এই ধর্মভিত্তিক উন্মাদনা গোটা বিশ্বেই এখন আলোচনার বিষয় বটে। হৃদয় মণ্ডল, আমোদিনী পাল কিংবা তারও আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনাসমূহ বেশ ফলাও করেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। প্রতিবেশি ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা চরম আকার ধারণ করায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেক ক্ষেত্রে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
তারা বলছেন, ধর্ম হয়ে যাচ্ছে ফ্যাশনের অঙ্গ। ব্যক্তিগত ধর্মপালন হয়ে যাচ্ছে লোক দেখানো ফ্যাশন। ধর্মের গভীর মর্মবাণী উপলব্ধি না করে অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণার জন্ম হচ্ছে মনে। এই অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা সমাজ থেকে উঠে আসছে না।
কেন উঠে আসছে না, তারও তো রয়েছে একটি বড় কারণ। সচেতন যে বাঙালি একসময় জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, তাদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এবং মিতালি পাতিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কৌশলী মানুষের সঙ্গে। ভুলে গেলে চলবে না, অস্ত্রহাতে যে কৃষক-শ্রমিক যুদ্ধ করেছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধের পর অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে গিয়েছিল যে যার কাজে। কিন্তু যারা অস্ত্র জমা দেয়নি, হাইজ্যাক লুটতরাজ ইত্যাদি করে পয়সার মালিক হয়েছে, তারা নৈতিকভাবে চেতনা থেকে সরে যাওয়ায় স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাত করতে বাধ্য হয়েছে। এভাবে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হতে পারেনি বাংলাদেশ।
এই অজ্ঞতা ও ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়া আরও যেসব কারণে ঘটেছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ একটা ক্রান্তিকাল কাটাচ্ছে। এখনই কিছু ব্যাপারে বোধোদয় হওয়া দরকার। যার প্রথমটাই হচ্ছে, পরিবারের মধ্যে দেশপ্রেম জাগানো, শিক্ষালয়ের শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা। চারপাশের মানুষ যদি শুধু হতাশার কথাই বলতে থাকে, এমনকি বলতে থাকে, পাকিস্তান আমলে ভালো ছিলাম, তাহলে বুঝতে হবে দেশের মস্তিষ্কে বড় অসুখ হয়েছে। শুরুতে যে পাঠাগারের কথা বলা হলো, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হওয়ার এটাই বড় কারণ। বইপড়ার মাধ্যমে বদলে যেতে পারে মনের মানচিত্র। যতটা পিছিয়ে এসেছি আমরা, ততটা এগিয়ে গিয়ে তারপর নতুন পথ সৃষ্টি করার জন্য বইয়ের ওপর নির্ভর করা যায়। তবে সেটাও নির্ভর করছে কোন বইগুলো পড়া হচ্ছে সেই বিসমিল্লাহ সেলুনে, তার ওপর। গল্প-উপন্যাস তো থাকবেই, পরোক্ষভাবে মনের গঠন তৈরি করে দেয় এরকম বই। সঙ্গে থাকতে হবে, মুক্তিযুদ্ধ এবং ইতিহাসভিত্তিক বই। খাদের কিনারায় দাঁড়ানো একটি প্রজন্মের জন্য এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময়।
তারা বলেন, সেই আশা বুকে থাকলে জীবনটা আনন্দময় হয়ে ওঠে। কিন্তু সে পথের দিশা পেতে হলে ত্যাগ, পরিশ্রম এবং চর্চার বিকল্প নেই।
সেই পরিবর্তনটা আসছে, এরকম ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু সত্যিই কি আসছে, সে কথা ভেবে দুশ্চিন্তাও তো পাশাপাশি বাসা বাঁধে মনে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৪৪
আপনার মতামত জানানঃ