সৌদি আরবে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কর্মজীবী নারীদের বড় একটা অংশের মাঝে ছোট চুল-প্রীতিও বাড়ছে। রাজধানী রিয়াদে তাই প্রায়ই দেখা যায় বয়-কাট চুলের সৌদি নারী।
সৌদি আরবের অনেক কর্মজীবী নারীরই এখন ছোট চুল খুব পছন্দ। রিয়াদের হেয়ারড্রেসার লামিস জানান, এখন তার কাছে এসে প্রতি ৩০ জনের অন্তত সাত-আটজনই বলেন বয়-কাট করে দিতে। তার মতে, ‘এই হেয়ারকাট এখন খুব জনপ্রিয়৷ বিশেষ করে নারীরা শ্রমবাজারে প্রবেশের পর এই হেয়ারকাটের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে’।
ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার পর তেলনির্ভর সৌদি আরবের অর্থনীতিকে আরো বিস্তৃত করার উদ্যোগ নেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এ লক্ষ্যে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেন তিনি। ভিশন ২০৩০-এর বড় একটা অংশ জুড়েই ছিল কর্মক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণ বৃদ্ধির পরিকল্পনা।
মোহাম্মদ বিন সালমান চেয়েছিলেন এক দশকের মধ্যে দেশের কর্মক্ষেত্রে অন্তত ৩০ ভাগ নারীর অংশগ্রহণ। মাত্র পাঁচ বছরে সেই লক্ষ্য পেরিয়ে গেছে সৌদি আরব। গত মে মাসে দাভোসের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে সৌদি আরবের পর্যটন মন্ত্রী প্রিন্সেস হাইফা আল-সাউদ জানান, বর্তমানে কর্মক্ষেত্রের ৩৬ ভাগই নারী।
তিনি আরো জানান, এ মুহূর্তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ৪২ ভাগের মালিকই নারী।মোহাম্মদ বিন সালমানের সময়ে সৌদি নারীদের হিজাব পরার প্রবণতা কমেছে। অনেক কর্মজীবী নারীই এখন মনে করেন, কর্মস্থলে হিজাব পরে দ্রুত চলাফেরা করা কঠিন। অনেকে হিজাব পরেন না। তাদের অনেকে মিশরের অভিনেত্রী ইয়াসমিন রায়েসসহ আরব বিশ্বের অনেক তারকাকে অনুসরণ করে বয়কাট চুল রাখছেন।
পুরুষের পরিধেয় বস্ত্র কারখানা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত আবির মোহাম্মেদ নামের ৪১ বছরের এক নারী বলেন, ‘আমি কর্মজীবী নারী। চুলের যত্ন নেওয়ার মতো সময় আমার নেই। আমার চুল কোঁকড়ানো। সকালে কাজে বের হওয়ার আগে বড় চুলের পরিচর্যা করার মতো সময় আমার হাতে নেই।’
২৯ বছরের রোজ রিয়াদের একটি মলে জুতার দোকানে বিক্রেতার কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘ছোট চুলের কারণে তিনি নিজেকে আলাদা ও স্বাধীন বলে ভাবেন। প্রথম দিকে আমার পরিবার আপত্তি জানিয়েছিল। তবে পরে তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।’
প্রসাধনীর দোকানে কাজ করেন নাউফ। তিনি বলেন, ‘ছোট চুলের মাধ্যমে আমরা বোঝাতে চাই সমাজে পুরুষের চেয়ে আমাদের ভূমিকা খুব বেশি আলাদা নয়। ছোট চুল নারীদের শক্তির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন তিনি।
ছোট চুলের মাধ্যমে আমরা বোঝাতে চাই সমাজে পুরুষের চেয়ে আমাদের ভূমিকা খুব বেশি আলাদা নয়। ছোট চুল নারীদের শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
২০১৭ সালের পর সৌদির পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। যুবরাজ সালমান দেশটির সামাজিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনায় আগের চেয়ে স্বাধীনভাবে চলতে ফিরতে পারছেন নারীরা। ২০১৭ সালের আগে সৌদিতে নারীদের সাইকেল চালানোর কথা যেখানে ভাবাই যেতো না।
২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয় দেশটি। ফলে গাড়ি চালাতে সৌদি নারীদের আর কোনো পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে না। এছাড়া গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাচ্ছেন তারা।
ওজন ও উচ্চতার শর্ত পূরণ করে নারীরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবে। তবে অন্তত উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করা লাগবে তাদের।
২০২০ সালে সৌদি আইন মন্ত্রণালয় ১০০ নারীকে পাবলিক নোটারি হিসেবে নিয়োগ দেয়। চলতি বছর জানুয়ারিতে ঘোষণা দেওয়া হয়, শিগগিরই আদালতে নারী বিচারকও নিয়োগ দেওয়া হবে।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো নারী বিমানবালা নিয়োগ দেয় সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনস। দেশটিতে নারী যাত্রীদের সেবার জন্য ৫০ জন বিমানবালা নিয়োগ করা হয়।
সৌদি আরবকে আরও আধুনিক, উদার এবং ব্যবসা ও পর্যটনবান্ধব করতে ২০১৬ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছিলেন ক্রাউন প্রিন্স মোহামেদ বিন সালমান৷ এরপর বেশ কিছু আইনে পরিবর্তন করা হয়৷ ফলে সেদেশের নারীরা এখন গাড়ি চালানো, একা সিনেমা হলে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়াসহ নানান কাজ করতে পারছেন৷
সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোও ভিশন ২০৩০ এর অংশ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে৷ এমনও কথা শোনা যাচ্ছে, সেখানে অ্যালকোহল পান বিষয়ে সীমিত পরিসরে হলেও অনুমোদন দেয়া হতে পারে৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কট্টর রক্ষণশীল দেশ হিসেবে পরিচিত সৌদি আরব দেরি হলেও নিজেদের বুঝতে পারার চেষ্টা করছে। উবার চালানো, সাইকেল চালানো সৌদি নারীদের জন্য যুগান্তকারী এক ব্যাপার বটে। বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন নারীদের মতো সৌদি আরবের নারীরাও নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পাবেন এমন প্রত্যাশা লক্ষণীয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/০০২৭
আপনার মতামত জানানঃ