সিলেট ও সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যায় জনদুর্ভোগ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বন্যা কবলিত এলাকায় বিশেষ করে খাদ্য ও সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। অপরদিকে খাদ্য সঙ্কটের এ চরম পরিস্থিতিতে কিছু নিত্যপণ্য পাওয়া গেলেও কিনতে হচ্ছে চড়া দাম দিয়ে।
বন্যার দুর্দশাকে পুঁজি করে হঠাৎ বেড়েছে চিড়া, মুড়ি থেকে শুরু করে চাল, ডাল, তেল, পেয়াজসহ সকল নিত্যপণ্যের দাম। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
দোকানিদের এমন অমানবিক আচরণে এক দিকে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে, অন্য দিকে ত্রাণ তৎপরতায় এগিয়ে আসা রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সামর্থবান ব্যক্তিরা তাদের কার্যক্রম চালাতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
তারা বলছেন, এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ত্রাণপণ্যের বাজারে এমন আগুন পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
জানা গেছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জে সপ্তাহের ব্যবধানে চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে বন্যার আগে ২৫ টাকা কেজির আলু এখন ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি মসুর ডালের দাম ছিল ১২০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায়। আর চাল কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে।
গতকাল বিকেলে সিলেটের ব্রহ্মময়ী বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৫২ থেকে ৫৫, আলু ২৮ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ১০ দিন আগেও প্রতি কেজি আলু ২০ থেকে ২২ এবং প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শুকনা খাবারের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি মুড়ি ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৮০ টাকায় এবং চিড়া প্রতি কেজি ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বন্যাক্রান্ত অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই পেলেও খাদ্য সংকট থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে সবজির দাম দ্বিগুণ হয়েছে। গতকাল মানিকদাইড় বাজারের আনোয়ার স্টোরের মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, গতকাল মোটা মসুর ডাল ১২০, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ১২০ ও মুড়ি ৬২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে এই বাজারে প্রতি কেজি মসুর ডাল ১১৫, কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৪০ টাকা ও মুড়ি প্রতি কেজি ৫৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
কুড়িগ্রামের বন্যাকবলিত রৌমারীর খেওয়ারচর বাজারে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ও পটোল ৬০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগেও প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৪০ ও পটোল ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কয়েক দিন আগেও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি শসা বিক্রি হতো ৩৫ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়। রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া বাজারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও বেগুনের কেজি ছিল ৩০ টাকা। ৪০ টাকা কেজির কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়।
বন্যাক্রান্ত অনেক মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই পেলেও খাদ্য সংকট থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
দাবি-চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না বন্যা দুর্গতরা। সুপেয় পানি না পাওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই বানের পানি পান করছেন মানুষ। ফলে পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও অপরিবর্তিত আছে সুনামগঞ্জের বন্যা। রাস্তা কাটায় সুনামগঞ্জ থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে।
সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নীত হলেও দুর্ভোগ কমছে না বন্যার্তদের। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সমস্যায়। পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌবাহিনী, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা মাঠে নেমেছেন।
বন্যার্তদের জন্য সিলেট নগরীতে আশ্রয়কেন্দ্র খুললেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সেভাবে দেখভাল করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ছড়ারপার এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল বলেন, এক দিন কেবল খাবার পেয়েছিলাম। এরপর আর কিছু পাইনি। আমরা বয়স্করা না হয় কষ্ট করে উপোস থাকলাম। কিন্তু বাচ্চারা তো থাকতে পারছে না।
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতী হলেও অপরিবর্তিত রয়েছে সুনামগঞ্জ। পানিবন্দী এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট। দ্রুত এর সমাধান করা না গেলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।
বানভাসি মানুষ জানিয়েছে, বাড়িতে যেসব খাবার ছিল সেই মজুত শেষ হয়ে গেছে। নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় এখন হাহাকার চলছে।
সুনামগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুয়েল মিয়া গতকাল বুধবার বলেন, কিছু দোকানি অমানবিক আচরণ করেছেন। শনি ও রোববার অনেক বেশি দামে পণ্য বিক্রি করেছেন। প্রশাসনের উচিত বাজার তদারকি করা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মহামারি করোনা এরই মধ্যে আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, আমাদের অনেককে নিঃস্ব করে দিয়েছে। কমবেশি সবার মধ্যেই পড়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। অনেকে সবকিছু হারিয়ে অর্থকষ্টে দিনযাপন করছে। অন্তত সাধারণ জনগণের কথা ভেবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলোর যেন ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করা হয় এবং তা যেন সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। সহনশীল মাত্রায় মূল্য নির্ধারণের জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২১
আপনার মতামত জানানঃ