ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে সিঙ্গাপুরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। দেশটি এরইমধ্যে জানিয়েছে তারা ‘ডেঙ্গু এমার্জেন্সি’ মোকাবেলা করছে।
সিঙ্গাপুরে প্রায় প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তবে এ বছর সেই সময়ের অনেক আগেই শুরু হয়েছে এডিস মশার প্রকোপ। তার চেয়েও আশঙ্কার কথা, মৌসুম শুরুর আগেই গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন সেখানে। ফলে কিছুদিন পরে কী পরিস্থিতি হবে, তা রীতিমতো ভয় জাগাতে শুরু করেছে সিঙ্গাপুরে।
সিএনএনের খবর অনুসারে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশটিতে ২০২১ সাল জুড়ে মোট ৫ হাজার ২৫২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরে এরই মধ্যে ১১ হাজারের বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছেন।
খবরে জানানো হয়, সাধারণত জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে শুরু করে। সেখানে এ বছর জুনের আগেই ১১ হাজার ছাড়িয়েছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিঙ্গাপুর যে সংকটে রয়েছে তা এ অঞ্চলের অন্য দেশেও কম-বেশি দেখা যাচ্ছে। এ জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এই পরিস্থিতি শুধু সিঙ্গাপুরের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী বছরগুলোতে এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব আরও নিয়মিত হয়ে উঠতে পারে।
ডেঙ্গু কোনো ছোটোখাটো রোগ নয়। এতে ফ্লুর মতো উপসর্গ, যেমন- তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা এবং শরীরে ব্যথা দেখা দেয়। গুরুতর অবস্থায় রক্তপাত, শ্বাসকষ্ট, অঙ্গহানি, এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডেসমন্ড ট্যান বলেছেন, দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ এখন জরুরি পর্যায়ে চলে গেছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার পেছনে এখানকার চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া দায়ী। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে দীর্ঘ সময় ধরে গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে এবং সময়ে সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টি হওয়ার কারণে তৈরি হওয়া অনুকূল পরিবেশে মশা এবং ভাইরাস উভয়ই ছড়িয়ে পড়ছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত বৈশ্বিক ডেঙ্গু প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এখন মানুষ এ রোগে নিয়মিত আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৫০ বছরে সারাবিশ্বে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ গুণ বেড়েছে।
এই পরিস্থিতি শুধু সিঙ্গাপুরের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই দুশ্চিন্তার বিষয়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামী বছরগুলোতে এ ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব আরও নিয়মিত হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ‘কেবল (ডেঙ্গু) সংক্রমণের হারই বাড়ছে না, নতুন নতুন জায়গায় এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও তা মহামারির আকার ধারণ করেছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে রেকর্ড ৫২ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপে হাজারো মানুষের মৃত্যু হয় সে বছর। এই রোগে ফিলিপাইনে হাজারো মানুষের মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে ডেঙ্গুকে জাতীয় মহামারি হিসেবে অভিহিত করা হয়।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। সে বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত প্রথম ৫ মাসে মাত্র ৩২৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল ছিল। পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপে অনেকে সঠিক চিকিৎসা পেতে সমস্যায় পড়েন।
একই বছরে, আফগানিস্তানে প্রথমবারের মত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়।
২০২০ সালে সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৩৫ হাজার ৩১৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ২৮ জন মারা যান।
এ বছর এ পর্যন্ত মাত্র ১ জনের মৃত্যু হলেও সংক্রমণের হার বাড়তে থাকায় দেশটির কর্তৃপক্ষ সতর্কাবস্থা বজায় রাখছে।
সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘২০২২ এর ২৮ মে পর্যন্ত ১১ হাজার ৬৭০ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।’
মুখপাত্র আরও জানান, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তবে এখনও তা গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে রয়েছে।
তবে প্রথাগত ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর আগেই এত মানুষ আক্রান্ত হওয়ায় মেডিকেল বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, চলতি বছর দেশটিতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ক্ল্যারেন্স ইও জি কিন বলেন, ‘ডেঙ্গু একটি মৌসুমি রোগ। যখন আবহাওয়া উষ্ণ হতে শুরু করে ও গরম বাড়তে থাকে, তখনই বেশি রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন।’
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আরও জানান, বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীর হাসপাতাল বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
‘তবে কোনো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে রোগ জটিল আকার ধারণ করতে পারে, যা থেকে মৃত্যুও হতে পারে।’– যোগ করেন তিনি।
উদীয়মান সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুলের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো রুকলানথি দে আলউইস জানান, সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার পেছনে গরম, আর্দ্র আবহাওয়া ও ভাইরাসের একটি শক্তিশালী নতুন ধরনই মূলত দায়ী।
তার আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘আগের প্রেডিকটিভ মডেলিং গবেষণা থেকে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়বে, যার কারণে আরও বেশি পরিমাণ ভূখণ্ড মশার প্রজনন উপযোগী হয়ে ওঠবে এবং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়বে ডেঙ্গুর বিস্তার।’
তিনি বলেন, অতীতের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক মডেলগুলো দেখিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন শেষ পর্যন্ত ভৌগলিক এলাকা বাড়িয়ে দেবে (যেখানে মশার বংশবৃদ্ধি হয়), সেইসঙ্গে ডেঙ্গু সংক্রমণের মৌসুমগুলোকেও দীর্ঘায়িত করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি যেমন পরিবেশগত, তেমনি একই সঙ্গে তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকও বটে। উন্নত দেশগুলোর কারণেই এই জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তাদের কার্বন উদ্গিরণ হ্রাসে বাধ্য করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা, কার্যকর কূটনীতি ও রাজনীতি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৪
আপনার মতামত জানানঃ