তাঁর নয়ছয়ের ধরনটা শৈল্পিক। পুলিশে চাকরি দেওয়ার নামে কতজনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়েছেন তার হিসাব নেই। পছন্দের থানায় পোস্টিং নিতে চাইলে টাকার ‘গন্ধ’ পেলেই হলো, এক তুড়িতেই বদলির ব্যবস্থা! আর চাঁদাবাজির জন্য তিনি মহাসড়কে ‘হেডমাস্টার’। গল্পটা ‘ক্ষমতাধর’ ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) সৈয়দ মিলাদুল হুদার, যিনি ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের রাজশাহী রেঞ্জের (বৃহত্তর রাজশাহী) অঘোষিত ‘রাজা’। বদলি, নিয়োগ বাণিজ্য কিংবা চাঁদাবজি হুদা ছাড়া যেন জমেই না।
‘টাকায় টাকা আনে’—এ রসায়ন পুলিশের এই কর্তা ভালো বোঝেন। এ কারণে নয়ছয়ের টাকার বস্তা বাসায় আলমিরাবন্দি না করে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে ঢুকিয়েছেন। নামে-বেনামে বিভিন্ন জেলায় তাঁর রয়েছে বাড়ি, গাড়ি, জমি, প্লট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। একাধিক নামে শেয়ারবাজারে আছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার বিনিয়োগ। আর তাতেই এখন কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদের চূড়ায় সৈয়দ মিলাদুল হুদা। তাঁর এসব অবৈধ সম্পদ নিয়ে এরই মধ্যে অভিযোগ পৌঁছেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সিকিউরিটি সেলে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও হুদার এসব বেহুদা কাণ্ডের খোঁজে তদন্তে নেমেছে।
ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) সৈয়দ মিলাদুল হুদার বাড়ি বগুড়া শহরের তেলিহারা গ্রামে। তাঁর বাবা প্রয়াত জাহাঙ্গীর হুদা পেশায় ছিলেন সেটলমেন্ট অফিসের আমিন। চাকরি সূত্রে এখন তাঁর সিরাজগঞ্জে নোঙর। এখন সেখানে ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর (প্রশাসন) পদ সামলাচ্ছেন তিনি। ১৯৮৬ সালে সার্জেন্ট হিসেবে পুলিশে যোগ দেন হুদা। আর ২০০৬ সালে তিনি ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান। চাকরিজীবনের দীর্ঘ ৩৪ বছরের পুরো সময়ই তিনি রাজশাহী রেঞ্জে (বৃহত্তর রাজশাহী) পোস্টিং নিয়ে ছিলেন। এর মধ্যে শেষ ১০ বছর সিরাজগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশে আছেন তিন দফায় সাড়ে ৯ বছর। এ ছাড়া র্যাব-১২ সিরাজগঞ্জ ইউনিটে চাকরি করেছেন আরো দুই বছর। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হুদা পৈতৃক সূত্রে কোনো জমি না পেলেও পুলিশের চাকরি তাঁর জন্য হয়ে ওঠে ‘আলাদিনের চেরাগ’। সেই চেরাগের অলৌকিক ক্ষমতায় হুদা এখন জিরো থেকে হিরো।বগুড়ার তেলিহারা গ্রামবাসী ও হুদার আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামে ভিটামাটি ছাড়া খুব বেশি সম্পদ ছিল না তাঁর পরিবারের। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল মতিন বলেন, ‘হুদার বাবা ছিলেন ভবঘুরে টাইপের মানুষ। তাঁদের বসতবাড়ি ছাড়া আর কোনো সম্পত্তি ছিল না।’ প্রতিবেশী আত্মীয় ব্যবসায়ী আপেল বলেন, ‘পুলিশে চাকরি নেওয়ার পরই কপাল খোলে হুদার। তিনি বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর ও নিজ গ্রাম তেলিহারায় বাড়ি ও জমি কিনতে শুরু করেন। তিন মাস আগে তিনি গ্রামে এসে প্রায় এক কোটি টাকায় দুটি জমি বেচেন। সেখানে এখনো তিন থেকে চার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে।’
গত ২০ সেপ্টেম্বর বগুড়া দুর্নীতি দমন কমিশনে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মিলাদুল হুদার বিরুদ্ধে অসৎ উপায়ে সম্পদ অর্জনের ব্যাপারে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। দুদকে পাঠানো সেই অভিযোগে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে মিলাদুল হুদা নামে-বেনামে বগুড়াসহ আশপাশের জেলাগুলোতে কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছেন। তাঁর পরিবারের সদস্য ছাড়াও বিশ্বস্ত আত্মীয়-স্বজনের নামে তিনি কেনেন এসব সম্পদ। এ ছাড়া সরকারি বিধি ভঙ্গ করে এক যুগ সময় ধরে সিরাজগঞ্জে অবস্থান করা এবং পুলিশে লোক নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করার তথ্যও দুদকের ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধান ও ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হুদার নিকটাত্মীয়দের দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, বগুড়া শহরের ভিআইপি এলাকা জলেশ্বরীতলায় এন জে টাওয়ার ভবনে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, সূত্রাপুর রিয়াজ কাজী লেনে ফাতেমা লজ ভবনে পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট, মালতীনগর ট্রপিক্যাল হাউজিংয়ে একটি ফ্ল্যাট এবং বগুড়ার জামিল শপিং সেন্টারে তাঁর একটি দোকান রয়েছে।
এ ছাড়া রাজশাহীতে রাজপাড়া থানার সামনে রয়েছে একটি পাঁচতলা ভবন এবং রাজশাহীর লক্ষ্মীপুরে রয়েছে আরো একটি ছয়তলা ভবন। রাজশাহী নিউ মার্কেটে দুটি দোকানসহ উপশহরে রয়েছে প্লট করে বিক্রির জন্য এক বিঘা জমি।
এখানেই শেষ নয়। সিরাজগঞ্জের এসএস রোডে রয়েছে দুটি বড় দোকান এবং সেখানে নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবনের ব্যাবসায়িক পার্টনার তিনি। এ ছাড়া রংপুরের মুন্সিপাড়ায় একটি টিনশেড বাড়িসহ জমি এবং ঢাকার পলওয়েল মার্কেটে একটি বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে তাঁর। রয়েছে ব্যক্তিগত টাকায় কেনা দুটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেট কার।
হুদার নিকটাত্মীয়দের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পৈতৃক সূত্রে তিনি কোনো জমিই পাননি। যা কিছু করেছেন, তা পুলিশে চাকরি করেই। হুদা ট্রাফিকের পুলিশ ইন্সপেক্টর হলেও এলাকায় তিনি ‘দাপুটে ওসি’ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন।
তেলিহারা গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ‘নিজের ভাই-বোনের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক নেই। এলাকার লোকজনের কোনো উপকার না করে উল্টো বিপদে ফেলানোর চেষ্টা তাঁর। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাঝেমধ্যে গ্রামে আসেন জমি কেনাবেচা করতে।’
সিরাজগঞ্জ ট্রাফিক অফিসে হুদা দায়িত্বে থাকাকালে মোটরযানের মামলা ভাঙানোর নামে প্রায় দেড় কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৭ সালে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ঘুষ নিয়ে পুলিশে লোক নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে সিরাজগঞ্জ থেকে হুদাকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তদবির করে আবারও সিরাজগঞ্জে আগের পদে ফেরেন।
হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল প্রসিকিউশন শাখায় কনস্টেবল আব্দুর রাজ্জাক নামের একজনের মাধ্যমে মামলা ভাঙানোর নাম করে প্রতি মাসে ৩০ লাখেরও বেশি টাকা আত্মসাৎ করার। এই অভিযোগেই কনস্টেবল আব্দুর রাজ্জাককে সিরাজগঞ্জ থেকে বদলি করা হয়। মহাসড়কে বিভিন্ন যানবাহন থেকে জরিমানা মামলাপ্রতি হাজার হাজার টাকা আদায় করলেও কনস্টেবল আব্দুর রাজ্জাক শ্রমিক ও মালিকদের আদায় করা জরিমানার টাকার কোনো বৈধ রসিদ না দিয়ে ভুয়া স্লিপ দিতেন। মামলা ভাঙানোর আদায় করা টাকা থেকে মামলাপ্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা ট্রেজারি খাতে জমা দিয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করা হতো। রাজ্জাক চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন টিআই হুদার বিশ্বস্ত সার্জেন্ট আবু হাসান, সার্জেন্ট নাজমুল হক, এটিএসআই শাহাদৎ হোসেন ও এটিএসআই মতিন।
গত ১০ সেপ্টেম্বর মিলাদুল হুদাসহ সার্জেন্ট আবু হাসান, সার্জেন্ট নাজমুল হক ও এটিএসআই শাহাদৎ হোসেনের বিরুদ্ধে রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজির কাছে ও পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সিকিউরিটি সেলে চাঁদাবাজির অভিযোগ করা হয়। অভিযোগকারী ছিলেন নাটোর, পাবনা ও রাজশাহীর কাঁচামাল এবং মাছ ব্যবসায়ীর পক্ষে অনিল দাস। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘদিন থেকে সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা ট্রাফিক ফাঁড়ি, কড্ডার মোড় ট্রাফিক ফাঁড়ি ও যমুনা সেতুর পশ্চিম থানায় গাড়ি তল্লাশির নামে অভিযুক্তরা অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করছেন। এই চাঁদার পরিমাণ গাড়িপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া কয়েক শ গাড়ির কাছ থেকে মাসিক চাঁদাও তাঁরা তোলেন।
এ ব্যাপারে মালিক শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা ওসমান আলী খান জানান, তিনি নিজে সিরাজগঞ্জের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মিলাদুল হুদা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে রেঞ্জ ডিআইজির কাছে মৌখিক অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী মালিকরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তাঁদের চাঁদাবাজির ভয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী মালবোঝাই গাড়ি চলাচল অনেকটাই কমে গেছে।
বগুড়ার দুদক কার্যালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিলাদুল হুদার দুর্নীতির বিষয়ে একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত টিআই মিলাদুল হুদা বলেন, ‘আমি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করি না।’ তবে কিভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন সে ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তাঁর বিরুদ্ধে আসা চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ সত্য নয় বলে তিনি দাবি করেন।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার হাসিবুল আলম বলেন, সিরাজগঞ্জে আগে বেশ খারাপ পরিস্থিতি ছিল। ৯ মাস হলো তিনি জেলার দায়িত্ব নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের চেষ্টা করছেন। টিআই মিলাদুল হুদার ব্যাপারে তিনি কোনো লিখিত অভিযোগ পাননি।
আপনার মতামত জানানঃ