পরিবেশ দূষণজনিত অসুস্থতায় বাংলাদেশে বছরে খরচ হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। ‘পরিবেশদূষণ ও সুরক্ষাবিষয়ক তারুণ্য জরিপ-২০২২’ এ উঠে এসেছে এসব তথ্য।
গবেষণা ও পরামর্শ সেবা প্রতিষ্ঠান ‘চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ’ এই জরিপ করে। গতকাল শনিবার রাজধানীর বনানীতে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনের তথ্য।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং পানিবাহিত রোগকে পরিবেশদূষণজনিত অসুস্থতার কারণ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই দূষণে প্রতি পরিবারের বছরে গড়ে চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয় ১০ হাজার ৫৮৭ টাকা করে। দূষণের অসুস্থতায় বছরে কর্মহীন কাটাতে হয় ১৭ দিন করে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে শনিবার অনুষ্ঠিত আয়োজনে প্রধান বক্তা ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
প্রতিবেদন প্রকাশের পর তিনি বলেন, নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পরিবেশের টেকসই কাঠামো ভেঙে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা করছে না মানুষ। বায়ুদূষণই প্রধান দূষণ। কেননা, প্রতি মুহূর্তেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে হয়। তাই দূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।
চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান বলেন, তরুণদের নেতৃত্বে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণই এর সবচেয়ে ভালো সমাধান। পরিবেশ সুরক্ষায় সবুজ উদ্যোক্তা তৈরির বিকল্প নেই।
এই জরিপে অংশ নিয়েছে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ১ হাজার ২৩ জন। তারা প্রত্যেকেই জানান, গড়ে প্রতিদিন অন্তত একটি করে প্লাস্টিকের ব্যাগ তারা ব্যবহার করে থাকেন। ফলে শুধু তরুণেরাই বাংলাদেশে বছরে ১ হাজার ৮৭০ কোটি পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করেন।
কলকারখানা, যানবাহনের ধোঁয়ার সঙ্গে আছে নগরায়ণের বিরূপ প্রভাব। এসবই মারাত্মকভাবে প্রতি মুহূর্তে ধ্বংস করছে চারপাশের সবুজের বেষ্টনী। এর মধ্যে একটি গুরুতর কারণ প্লাস্টিকের ব্যবহার। পরিবেশ রক্ষায় বাইসাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোর সুপারিশ করেছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। অনুষ্ঠান থেকে পরিবেশ রক্ষায় ১০ দফা সুপারিশের প্রস্তাব করা হয়।
সকালে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে শুরু হয় বাইসাইকেল র্যালি। সব বয়সের অর্ধশতাধিক মানুষ এই র্যালিতে অংশ নিয়ে রাজধানীর সড়কে বাইসাইকেল চালান।
আয়োজকেরা বলেন, দেশকে পরিবেশদূষণের ক্ষতি থেকে বাঁচাতে হলে সরকারের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের এই আয়োজনে সঙ্গে ছিল সমমনা আরও সাতটি প্রতিষ্ঠান।
এই সমস্যার এই ভয়াবহ রূপ বাংলাদেশ এই প্রথম দেখছে না। শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা গেছে দুই লাখের বেশি। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট–এ প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
প্রতিবেদনে পরিবেশদূষণকে বিশ্বে রোগ বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মাটি, পানি ও বায়ুদূষণের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ক্ষতি ও স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাবগুলো চিহ্নিত করা হয় প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চার ধরনের দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, বায়ু, পানি, সিসা ও কর্মক্ষেত্রে দূষণের শিকার হয়ে তখন দেশে মারা গিয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জন।
দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে প্রথম অবস্থানে ছিল ভারত। দেশটিতে মারা যায় ২৩ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৭ জন। বায়ুদূষণে মৃত্যুর দিক থেকেও ভারত শীর্ষে, তারপর যথাক্রমে বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানের অবস্থান ছিল।
পানিতে আর্সেনিক সমস্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীন। পানিতে আর্সেনিকের কারণে ক্যানসার, কিডনিজনিত রোগ, হৃদ্রোগ ও স্নায়ুজনিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
প্রতিবেদনটির প্রধান লেখক রিচার্ড ফুলার বলেন, জনস্বাস্থ্যের ওপর দূষণ ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে। আর এই মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের বোঝা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো বয়ে বেড়াচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বায়ু, সিসা ও রাসায়নিক দূষণ নিরসনের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে অতিদ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিশুদ্ধ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি দাতা সংস্থাগুলোর পরিবেশদূষণ ব্যবস্থাপনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করার ওপরও জোর দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ