সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ।
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে স্থানীয় মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে চালানো তিন দিনের অভিযানে শত শত বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে দেশটির জান্তা বাহিনী। শনিবার(০৪ জুন) স্থানীয় গণমাধ্যম এবং বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে দেশটির সামরিক বাহিনী। এর পর থেকে প্রতিনিয়ত আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে দেশটির গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
এনডিটিভির প্রতিবেদনে জানা যায়, সামরিক অভ্যুত্থানের জেরে মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেখানে জান্তা বিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রায়ই সংঘাতে জড়াচ্ছে জান্তা সদস্যরা। সবশেষ গেল সপ্তাহে কিন, আপার কিন ও কে তাউং গ্রামে শত শত বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে সেনারা।
কিনের এক বাসিন্দা জানান, জান্তা বাহিনীর হামলায় কিন গ্রামের মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তিনি বলেন, তার বাড়িসহ প্রায় দু শ বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কে তাউং গ্রামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘সেনাবাহিনীর সদস্যরা তল্লাশি অভিযানের পাশাপাশি আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা মোটর বোটগুলোও পুড়িয়ে দিয়েছে, যা আমরা যাত্রী পরিবহন ও খাবার বহনের জন্য ব্যবহার করি।’
সংবাদ সংস্থা এএফপির প্রকাশিত ড্রোন ভিডিওতে, ওই গ্রাম থেকে আকাশের দিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা গেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইট চিত্রেও ওই সব গ্রামে আগুন দেওয়ার ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অভ্যুত্থানের পর দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় সাগাইং অঞ্চলে ভয়াবহ সংঘর্ষ এবং রক্তক্ষয়ী প্রতিশোধের ঘটনা দেখা গেছে। স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সদস্যরা নিয়মিত জান্তা সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পিডিএফ মিলিশিয়াদের কার্যকর লড়াই জান্তা বাহিনীকে রীতিমতো বিস্মিত করেছে। এই মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে স্থল অভিযান চালাতে গিয়ে অসংখ্যবার বিমান হামলাও করেছে জান্তা সৈন্যরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেছেন, গত ২৬ মে সৈন্যরা গ্রামে দিকে এগিয়ে আসার সময় ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। এ সময় শত শত গ্রামবাসী কিন ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। পরের দিন সকালে সৈন্যদের চলে যাওয়ার আগে আমরা গ্রাম থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখেছি।
তিনি বলেন, দুই শতাধিক বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে… আমার বাড়ি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। শুধু কংক্রিটের ভিত্তি বাকি আছে।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা তল্লাশি অভিযানের পাশাপাশি আমাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা মোটর বোটগুলোও পুড়িয়ে দিয়েছে, যা আমরা যাত্রী পরিবহন ও খাবার বহনের জন্য ব্যবহার করি।’
সৈন্যরা বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমারের জান্তা। একই সঙ্গে ‘সন্ত্রাসী’ পিডিএফের যোদ্ধারা আগুনের সূত্রপাত করেছে বলে অভিযোগ করেছে সামরিক সরকার।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জান্তা প্রধান মিং অং হ্লেইং বলেছিলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাল্টা অভিযান চালানোর সময় যতটা সম্ভব হতাহত কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত দৈনিক গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারকে তিনি বলেন, এখন দেশ শান্ত আছে।
এর আগেও জান্তাদের বিরুদ্ধে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার এমন অভিযোগ উঠেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে, বাড়িঘর ধ্বংসের জন্য পিপলস ডিফেন্স ফোর্সকে দায়ী করেছে জান্তা সরকার।
চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত গত চার মাসে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ সাগাইংয়ে শতাধিক গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা। দেশটিতে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনের অংশ হিসেবে এসব গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বলে ধারণা করছে জাতিসংঘ। এতে সাড়ে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। খবর রয়টার্সের।
সম্প্রতি রয়টার্সের হাতে স্যাটেলাইটে তোলা কিছু ছবি এসেছে। ছবিগুলো তুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ ইমেজিং কোম্পানি প্ল্যানেট ল্যাবস ও দেশটির মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার কৃত্রিম উপগ্রহ। সেই সব ছবিতেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেওয়া আগুনে জ্বলে যাওয়া, ভস্মীভূত হওয়া গ্রামগুলোর কিছু ছবি এসেছে।
পরে এই ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে রয়টার্স জানতে পেরেছে যে, সেগুলো মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ সাগাইংয়ের বিভিন্ন গ্রামের ছবি। ভস্মীভূত কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা রয়টার্সের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, জান্তাবিরোধী কয়েকটি সশস্ত্রগোষ্ঠী এসব গ্রামকে নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে— এই সন্দেহে গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে সরকারি বাহিনী।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। বন্দি করা হয় অং সান সুচি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে। সেনা প্রধান মিন অং হ্লেইং এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের পরপরই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী জনগণ। রাজধানী নেইপিদো, বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুন, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়সহ ছোট বড় বিভিন্ন শহরে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়।
বিক্ষোভ দমনে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রথম দিকে লাঠিচার্য, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল, জল কামান ব্যবহার করলেও পরে জান্তার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা শুরু করে বাহিনীর সদস্যরা। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে ইতোমধ্যে দেশটিতে প্রায় ১৫ শ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
দেশটির একটি মানবাধিকার সংগঠনের বরাতে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মিয়ানমারে গত এক বছরের সংঘাতে ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই জান্তাবিরোধী। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি–হামলায় তারা প্রাণ হারান। এক বছরে দেশটিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ। আর জান্তার হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে ১৬৮ সেনা ও পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১২
আপনার মতামত জানানঃ